Syed Khondker Arif vs. State: সামরিক শাসনের অধীনে প্রদত্ত আইন বাতিল – একটি ঐতিহাসিক কেস স্টাডি


 আসসালামু আলাইকুম, Law Ministry BD ওয়েবসাইট এর পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই সু-স্বাগতম । আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় Syed Khondker Arif vs. State: সামরিক শাসনের অধীনে প্রদত্ত আইন বাতিল – একটি ঐতিহাসিক কেস স্টাডি সম্পর্কে।

বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে সামরিক শাসন এবং সেই সময়ে প্রদত্ত আইন নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন উঠেছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে একাধিকবার সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং তখনকার শাসকরা রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা দিতে Martial Law Proclamation, Martial Law Regulation (MLR), এবং Martial Law Order (MLO) প্রবর্তন করেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এগুলো কি সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এগুলো কি বৈধ?

Syed Khondker Arif vs. State মামলা সেই প্রশ্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এ মামলায় আদালত শুধু একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়েই কথা বলেননি, বরং সামরিক শাসনের অধীনে প্রদত্ত আইনগুলোর বৈধতা নিয়েও অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে এ মামলাটি বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে।

Syed Khondker Arif vs. State: সামরিক শাসনের অধীনে প্রদত্ত আইন বাতিল মামলার পটভূমি

সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপট

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। একের পর এক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে সামরিক শাসকরা।

  • প্রথমে ক্ষমতায় আসেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

  • এরপর সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ ক্ষমতা দখল করে।

  • ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন এবং Martial Law জারি করেন।

এই সময়ে অসংখ্য Martial Law Regulation (MLR) এবং Martial Law Order (MLO) জারি করা হয়। এগুলো সংবিধানের স্বাভাবিক ধারাকে পাশ কাটিয়ে সামরিক শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল।

মামলার সূত্রপাত

সামরিক শাসনের সময় একাধিক নাগরিককে আটক, বিচার ও দণ্ডিত করা হয়। Syed Khondker Arif ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে বলেন—

  1. সামরিক শাসনের অধীনে প্রদত্ত আইন সংবিধান পরিপন্থী।

  2. এই আইন অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক।

  3. তাঁর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।

এভাবে মামলাটি উচ্চ আদালতে গড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য সাংবিধানিক মামলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মূল আইনি প্রশ্ন

এ মামলায় মূলত তিনটি আইনি প্রশ্ন উঠে আসে—

  1. Martial Law শাসনব্যবস্থা কি সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

    • বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক।

    • ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংবিধানই রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র ভিত্তি।

    • সুতরাং, সংবিধান বহির্ভূত কোনো আইন বা শাসনব্যবস্থা বৈধ হতে পারে কি?

  2. Martial Law Regulation (MLR) ও Martial Law Order (MLO) এর বৈধতা কতটুকু?

    • সামরিক শাসনের সময় দেওয়া আইনগুলো সাধারণ আদালতে প্রযোজ্য কি না?

    • সেগুলো কি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সীমিত বা বাতিল করতে পারে

  3. আদালতের এখতিয়ার (Jurisdiction) কোথায় সীমিত?

    • সামরিক শাসনের সময় আদালতের এখতিয়ার খর্ব করা হয়েছিল।

    • কিন্তু আদালত কি তখনও মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম?


আদালতের রায়

বাংলাদেশের High Court Division এবং পরে Appellate Division মামলাটির রায় প্রদান করেন।

রায়ের মূল বক্তব্য

  1. সামরিক শাসনের অধীনে প্রদত্ত আইন সংবিধান-বহির্ভূত।

    • আদালত বলেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো শাসনব্যবস্থা বৈধ হতে পারে না।

    • জনগণের সম্মতি ছাড়া কোনো ক্ষমতা বৈধ নয়।

  2. MLR ও MLO অবৈধ।

    • আদালত ঘোষণা করেন, Martial Law Regulation এবং Order সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রণীত হয়েছিল।

    • এগুলোর মাধ্যমে মৌলিক অধিকার সীমিত বা বাতিল করার চেষ্টা অসাংবিধানিক।

  3. আদালতের এখতিয়ার সংরক্ষিত।

    • আদালত রায় দেন যে, বিচার বিভাগ সবসময়ই মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষমতা রাখে।

    • সামরিক শাসনের নামে আদালতের এখতিয়ার খর্ব করা যায় না।

রায়ের গুরুত্ব

  • আদালত প্রথমবার স্পষ্টভাবে বলেন যে, সামরিক শাসন ও তার অধীনে প্রদত্ত আইন সংবিধান-বহির্ভূত।

  • এটি পরবর্তী মামলাগুলোর (যেমন: Bangladesh Italian Marble Works Ltd. vs. Bangladesh – Fifth Amendment Case) ভিত্তি তৈরি করে।

  • গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এ রায় একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

মামলার আইনি বিশ্লেষণ

সংবিধানের মৌলিক কাঠামো

বাংলাদেশের সংবিধান Basic Structure Doctrine-এর ভিত্তিতে গঠিত, যা ৮ম সংশোধনী মামলায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

  • গণতন্ত্র

  • আইনের শাসন

  • বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

  • মৌলিক অধিকার

এসবই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। সামরিক শাসনের আইন এসবকে লঙ্ঘন করেছিল।

সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ

সংবিধানে বলা হয়েছে—জনগণই সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিক।

সুতরাং, কোনো সামরিক শাসক জনগণের সম্মতি ছাড়া ক্ষমতা দখল করে বৈধতা অর্জন করতে পারে না।

আন্তর্জাতিক আইন দৃষ্টিকোণ

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সামরিক শাসনকে অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, জনগণের মৌলিক অধিকার কোনো অবস্থায় বাতিল করা যায় না।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় প্রভাব

Syed Khondker Arif vs. State মামলাটি শুধু একজন ব্যক্তির অধিকার রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রে প্রভাব ফেলেছে।

  1. সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান আদালত প্রথমবার শক্তভাবে বললেন, Martial Law অসাংবিধানিক।

  2. পরবর্তী মামলার ভিত্তি তৈরি

    • Fifth Amendment Case (2005) → Martial Law-কে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

    • Seventh Amendment Case (2010) → জিয়াউর রহমানের Martial Law শাসনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা।

  3. গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এই রায় প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্রই রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র বৈধ পদ্ধতি।

সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা

যদিও এই মামলার রায় ছিল ঐতিহাসিক, তারপরও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল—

  • রায় দেওয়ার সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চাপ ছিল।

  • আদালত কখনো কখনো সামরিক শাসনের সঙ্গে আপস করেছে।

  • জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত সংস্কার হয়নি।

তবুও দীর্ঘমেয়াদে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে রয়ে গেছে।

উপসংহার

Syed Khondker Arif vs. State মামলাটি বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। এ রায়ে আদালত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, সামরিক শাসন সংবিধান-বহির্ভূত এবং এর অধীনে প্রদত্ত আইন অবৈধ।

এটি শুধু একটি মামলার রায় নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জয়। পরবর্তী সময়ে ৫ম ও ৭ম সংশোধনী মামলায় এ রায়ের প্রভাব পড়েছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এ মামলাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
👉 সংবিধানই রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র ভিত্তি।
👉 জনগণই ক্ষমতার উৎস।
👉 কোনো স্বৈরশাসন জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url