ড. মোহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ (পরিবেশ মামলা) – বাংলাদেশে Public Interest Litigation (PIL) প্রতিষ্ঠার মাইলফলক


আসসালামু আলাইকুম, Law Ministry BD ওয়েবসাইট এর পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই সু-স্বাগতম । আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ড. মোহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ (পরিবেশ মামলা) – বাংলাদেশে Public Interest Litigation (PIL) প্রতিষ্ঠার মাইলফলক সম্পর্কে।

বাংলাদেশে পরিবেশ সুরক্ষা ও জনস্বার্থ মামলা (Public Interest Litigation – PIL) আজ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু এই ধারার সূচনা হয়েছিল একজন সাহসী পরিবেশবিদ ও আইনজীবীর প্রচেষ্টায়—ড. মোহিউদ্দিন ফারুক। তিনি Bangladesh Environmental Lawyers Association (BELA)-এর পক্ষে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন Dr. Mohiuddin Farooque vs. Bangladesh মামলায়, যা পরিচিত Ekushey Television / Environment Case নামেও।

এই মামলার মাধ্যমে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট প্রথমবারের মতো জনস্বার্থ মামলা (PIL) গ্রহণ করে এবং পরিবেশ সুরক্ষাকে সাংবিধানিক অধিকারের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।


ড. মোহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ (পরিবেশ মামলা) – বাংলাদেশে Public Interest Litigation (PIL) প্রতিষ্ঠার মাইলফলক মামলার প্রেক্ষাপট

পরিবেশগত সংকট

৯০-এর দশকে দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং পরিবেশ অবনতির কারণে বাংলাদেশ মারাত্মক পরিবেশ সংকটে পড়ে। বিশেষতঃ—

  • বন উজাড়,

  • নদী দূষণ,

  • শিল্প বর্জ্য,

  • অনিয়ন্ত্রিত নগর সম্প্রসারণ,

  • বায়ুদূষণ ইত্যাদি সমস্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব নিয়ে আদালতে যাওয়ার সাহস পেত না, কারণ আইন অনুযায়ী মামলা করার অধিকার কেবলমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া হয়েছিল।

Dr. Mohiuddin Farooque ও BELA

ড. মোহিউদ্দিন ফারুক ছিলেন Bangladesh Environmental Lawyers Association (BELA)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মনে করতেন, পরিবেশ সুরক্ষা কেবল ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং এটি একটি জনস্বার্থ বিষয়। তাই এর সুরক্ষায় আদালতের দ্বারস্থ হওয়া জরুরি।

মূল ঘটনা (Ekushey Television License Issue)

১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি, সরকার একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল (Ekushey Television – ETV) চালুর অনুমতি দেয়। কিন্তু লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে নীতিমালা লঙ্ঘন, স্বচ্ছতার অভাব এবং প্রযুক্তিগত অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

ড. ফারুক মনে করতেন, এটি কেবল বাণিজ্যিক নয়, বরং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট। কারণ—

  • রাষ্ট্রীয় সম্পদ (ফ্রিকোয়েন্সি স্পেকট্রাম) ব্যবহার হচ্ছে,

  • পরিবেশ ও জনগণের স্বার্থ জড়িত,

  • নীতি লঙ্ঘন করলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হতে পারে।

এই যুক্তিতে তিনি মামলা দায়ের করেন।


আদালতে মামলা (Case Proceedings)

প্রধান প্রশ্ন

  1. কে মামলা করার অধিকারী (Locus Standi)?
    আগে পর্যন্ত নিয়ম ছিল, কেবল যে ব্যক্তি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত সে-ই মামলা করতে পারবে। ড. ফারুক ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন না। তাহলে তিনি কি মামলা করতে পারবেন?

  2. পরিবেশ সুরক্ষা কি মৌলিক অধিকার?
    তিনি যুক্তি দেন, সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জীবনের অধিকার মানে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত।

আদালতের রায়

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেছিল—

  • জনস্বার্থে যে কেউ মামলা করতে পারে, যদি তা বৃহত্তর জনগণের কল্যাণের জন্য হয়।

  • পরিবেশ সুরক্ষা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার সংবিধানের অংশ

  • রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা জনগণের মৌলিক অধিকারের সাথে সম্পর্কিত।

ফলে আদালত Public Interest Litigation (PIL) এর বৈধতা স্বীকার করে।


রায়ের তাৎপর্য

১. PIL প্রতিষ্ঠা

এই মামলার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে Public Interest Litigation (জনস্বার্থ মামলা) প্রতিষ্ঠা পেল। এর ফলে—

  • সাধারণ জনগণ,

  • এনজিও,

  • আইনজীবী সংগঠন

সবাই জনস্বার্থে মামলা করতে পারবে।

২. পরিবেশকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি

আদালত বলেছিল, Right to Life = Right to a Healthy Environment। অর্থাৎ জীবনধারণ শুধু শ্বাস নেওয়া নয়, বরং সুস্থ পরিবেশে টিকে থাকার অধিকারও এর অংশ।

৩. রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা বৃদ্ধি

সরকার ও প্রশাসনকে জানানো হলো—

  • জনস্বার্থ উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আদালত সেটি বাতিল করতে পারে।

  • রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।


পরবর্তী প্রভাব

এই মামলার পর বাংলাদেশে অসংখ্য জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়, বিশেষ করে পরিবেশ নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ—

  • নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধ মামলা

  • বন উজাড় রোধ মামলা

  • বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ সংক্রান্ত মামলা

  • শিল্পকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মামলা

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (BELA) বহু মামলা করে পরিবেশ সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।


সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ

যদিও এই মামলা জনস্বার্থ মামলার নতুন দুয়ার খুলে দেয়, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও ছিল—

  • আদালতের রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা,

  • রাজনৈতিক প্রভাব,

  • পরিবেশ আইন বাস্তবায়নের ঘাটতি।

এখনো বাংলাদেশে অনেক পরিবেশ মামলা আদালতে থাকলেও রায় কার্যকর হতে দীর্ঘ সময় লাগে।


কেন এই মামলা ঐতিহাসিক?

  1. বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনস্বার্থ মামলা আদালত গ্রহণ করে।

  2. সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ব্যাখ্যা সম্প্রসারিত হয়।

  3. পরিবেশ সুরক্ষা বিচারব্যবস্থার অংশ হয়ে যায়।

  4. নাগরিক সমাজ ও এনজিওগুলো আদালতে ন্যায়বিচারের জন্য সরব হয়।


উপসংহার

Dr. Mohiuddin Farooque vs. Bangladesh (Environment Case / ETV Case) বাংলাদেশের আইনি ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। এটি শুধু একটি মামলাই নয়, বরং একটি আন্দোলনের সূচনা। আজ বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে, আর এর ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল এই মামলার মাধ্যমেই।

এই রায় প্রমাণ করে—আইন শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানুষের জীবন, পরিবেশ এবং ভবিষ্যতের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url