নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০২৫

 


আসসালামু আলাইকুম, Law Ministry BD ওয়েবসাইট এর পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই সু-স্বাগতম । আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২৫ সম্পর্কে।

শীর্ষক: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২৫: দ্রুত বিচার ও অধিক সুরক্ষার দিক

১. পটভূমি ও প্রয়োজনীয়তা

মাগুরার অষ্ট বছর বয়সী এক শিশুর ধর্ষণ ও মৃত্যুর পর জাতজৌলুসে আইন সংশোধনের দাবী উঠলে, ২০২৫ সালের মার্চে নারীবান্ধব একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়—নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ গেজেটে প্রকাশিত হয়। সূত্র: Arab News , Bangladesg Govt. Press , The Daily Star

২. কী কী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে?

(ক) দ্রুত বিচার নিশ্চিত

  • ধর্ষণ মামলার তদন্তকাল ৩০ দিন থেকে ১৫ দিন করা হয়েছে।

  • বিচার প্রক্রিয়া ১৮০ দিন থেকে ৯০ দিন এ নেওয়ার প্রস্তাব আছে—তবে কিছু জায়গায় এখনও ১৮০ দিনই চলমান থাকতে পারে। সূত্র: The Daily StarWikipedia

(খ) DNA রিপোর্ট ছাড়াই মামলা

  • আদালত অনুকূল মনের বিবেচনায় মেডিক্যাল রিপোর্ট বা প্রাপ্ত circumstantial evidence থাকলেই DNA রিপোর্ট ছাড়াই বিচার চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেল। সূত্র: BSS

(গ) মামলা-মধ্যস্থতা (Pre-case Mediation)

  • ধারা ২১(খ) সংযোজন: যৌতুকের কারণে সাধারণ জখম (ধারা ১১(গ)) মামলা , মামলা-মধ্যস্থতার আওতায় আনতে বাধ্য করা হয়েছে।

  • এবার ভুক্তভোগীকে আইনগত সহায়তা অফিসে (Legal Aid Office) গিয়ে প্রথমে মধ্যস্থতার আবেদন করতে হবে। যদি সংসোধিত প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়, তবেই আদালত মামলা গ্রহণ করবে। সূত্র: Prothomalo

(ঘ) আদালতের বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন

  • ধারা ৩৫ সংযোজন: ১১(গ) ধারার মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এর বদলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-এ বিচারাধীন হবে।সূত্র: Prothomalo

৩. ইতিবাচক দিকসমূহ

  • দ্রুত বিচারজরুরি সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সময় সীমা হ্রাসে নতুন ধারায় স্বাগত ঘোষণা।

  • বিচার প্রক্রিয়াকে নমনীয় করে তোলা হয়েছে, যেমন DNA ছাড়াই মামলা চলা এবং মধ্যস্থতাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া।

  • মেডিক্যাল ও আইনি সহযোগিতা ব্যবস্থা (সনদ, লিগ্যাল এইড) আইনভুক্ত হওয়ায় ভুক্তভোগীর সহায়তায় অগ্রগতি দেখা যাচ্ছেঃ “২০০০ থেকে কার্যকর ২০০৩ সংশোধনীর ধারায় আরও ভিকটিম-ফোকাসড পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে”সূত্র: BSSlawyerfarhadahmedbhuiyan.com

৪. সতর্কতামূলক দিক ও চ্যালেঞ্জ

  • আপসের বাধ্যতা: ভুক্তভোগীকে মধ্যস্থতার নিয়মে বাধ্য করা, বাস্তবে তাদের ন্যায়বিচার থেকে দূরে সরিয়ে অপস (আপস) করে দিতে পারে—বিশেষত সামাজিকভাবে দুর্বল স্থানায়নায়। সূত্র: Prothomalo

  • চিকিৎসা সনদের সংকট: মেডিক্যাল সনদ না থাকলে নির্যাতনের প্রমাণ জড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে—মধ্যস্থতায় চাপ পেলে প্রমাণ ও বিচার প্রক্রিয়া ঝুঁকিতে পড়তে পারে।Prothomalo

  • সম্প্রসারিত প্রক্রিয়া, তবে জটিলতা: সময় বাঁচানোর উদ্দেশ্য হলেও মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলে অতিরিক্ত ঠিকানা ও সময়সাপেক্ষ পথ ভুক্তভোগীদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।Prothomalo


মূল পরিবর্তন এবং গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো:

  • সংজ্ঞা পরিবর্তন (ধারা ২):

    • "বলাৎকার" এবং "যৌনকর্ম" এর নতুন ও স্পষ্ট সংজ্ঞা যোগ করা হয়েছে। বলাৎকার বলতে এখন ছেলে শিশুর মুখ বা পায়ুপথে যৌনকর্মকে বোঝানো হবে। যৌনকর্মের সংজ্ঞায় নারী বা শিশুর যোনি, পায়ুপথ বা মুখের অভ্যন্তরে পুরুষাঙ্গ বা অন্য কোনো বস্তু প্রবিষ্ট করাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

    • "মারাত্মক জখম"-এর সংজ্ঞা যোগ করা হয়েছে, যা Penal Code, 1860-এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

  • শাস্তি ও জরিমানা বৃদ্ধি (ধারা ৪, ৬):

    • আগের আইনের তুলনায় বিভিন্ন অপরাধের জরিমানা বহুগুণে বাড়ানো হয়েছে। যেমন, অনেক ক্ষেত্রে ১ লক্ষ টাকার জরিমানা ২০ লক্ষ টাকা করা হয়েছে।

    • ধর্ষণের ক্ষেত্রে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ড হতে পারে।

    • ধর্ষণের ফলে যদি নারী বা শিশুর যৌনাঙ্গ বা স্তনে মারাত্মক জখম হয়, তাহলে অপরাধীর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।

    • মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার শাস্তি যাবজ্জীবন বা অনধিক ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

  • মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা (ধারা ১৭):

    • যদি কোনো ব্যক্তি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক অভিযোগ দায়ের করেন এবং তা আদালতে প্রমাণিত হয়, তাহলে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারবে।

    • এর পাশাপাশি অভিযোগকারীকে সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডও দেওয়া যেতে পারে। এটি মিথ্যা মামলা প্রতিরোধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

  • মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্ধারণ ও কঠোরতা (ধারা ৮, ৯, ১০):

    • ধর্ষণ মামলার তদন্ত ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে হবে। পূর্বে এটি ৬০ দিন ছিল।

    • আদালতে অভিযোগ গঠনের পর ধর্ষণ মামলার বিচার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে হবে।

    • যদি কোনো কর্মকর্তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত বা বিচার শেষ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এই ব্যর্থতা তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (ACR) লিপিবদ্ধ হবে।

    • মামলার তদন্ত চলাকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রশাসনিক কারণে বদলি করা যাবে না।

  • ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক (ধারা ২৪, ৩২):

    • ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্মতি প্রয়োজন হবে না।

    • ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা বা আদালতে জমা দিতে হবে।

  • ভুক্তভোগীর সুরক্ষা (ধারা ১৪, ৩২খ):

    • কোনো নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। এর সাথে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের নাম-ঠিকানা বা ছবি প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

    • ট্রাইব্যুনাল বা ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে ভুক্তভোগী, অভিযোগকারী এবং সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।

  • নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠন (ধারা ২৬ক):

    • এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে শুধুমাত্র শিশু ধর্ষণ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য প্রতিটি জেলা ও মহানগর এলাকায় "শিশু ধর্ষণ অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল" গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এটি শিশুদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।

  • বিয়ের প্রলোভনে যৌনকর্ম (ধারা ৯খ):

    • যদি কোনো ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ১৬ বছরের বেশি বয়সের কোনো নারীর সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হন এবং এটি যদি তাদের মধ্যে আস্থাভাজন সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে করা হয়, তাহলে অপরাধীর সর্বোচ্চ ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ড হবে।

  • ভুক্তভোগীর মেডিক্যাল পরীক্ষা (ধারা ৩২):

    • সরকারি বা সরকার স্বীকৃত বেসরকারি হাসপাতালে ভুক্তভোগীর মেডিক্যাল পরীক্ষা বিনামূল্যে হবে।

    • হাসপাতালকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার রিপোর্ট বিনামূল্যে ভুক্তভোগী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিতে হবে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০২৫ PDF

এখানে আপনাদের সুবিধার জন্য  দেওয়া হল।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ঠিকানা

বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত একটি এস.আর.ও (Statutory Regulatory Order) অনুযায়ী, বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের নাম এবং তাদের স্থানীয় অধিক্ষেত্র (jurisdiction) নিচে দেওয়া হলো:

ঢাকা:

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১, ঢাকা: কোতয়ালি, বংশাল, গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, শ্যামপুর ও ওয়ারী থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২, ঢাকা: লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, নিউমার্কেট, শেরেবাংলানগর ও পল্লবী থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩, ঢাকা: ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, রামপুরা, রূপনগর ও সবুজবাগ থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪, ঢাকা: কেরানিগঞ্জ, দোহার, কামরাঙ্গীরচর, নবাবগঞ্জ ও কাফরুল থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫, ঢাকা: রমনা, মতিঝিল, পল্টন, শাহাবাগ, শাহজাহানপুর ও মুগদা থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬, ঢাকা: ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, আদাবর, কলাবাগান, তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্প এলাকা থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭, ঢাকা: উত্তরা, এয়ারপোর্ট, বাড্ডা, বনানী, ভাষানটেক ও ক্যান্টনমেন্ট থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮, ঢাকা: মিরপুর মডেল, দারুস সালাম, দক্ষিণখান, গুলশান, খিলক্ষেত ও শাহআলী থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯, ঢাকা: সাভার, ধামরাই, তুরাগ, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরখান ও ভাটারা থানা।

কিশোরগঞ্জ:

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১, কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জ সদর, হোসেনপুর, করিমগঞ্জ, নিকলী, ইটনা, মিঠামইন ও তাড়াইল থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২, কিশোরগঞ্জ: বাজিতপুর, কুলিয়ারচর, ভৈরব, অষ্টগ্রাম, কটিয়াদি ও পাকুন্দিয়া থানা।

জামালপুর:

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১, জামালপুর: সদর থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২, জামালপুর: দেওয়ানগঞ্জ, বকসিগঞ্জ, ইসলামপুর ও মাদারগঞ্জ, মেলন্দাহ, সরিষাবাড়ি ও নুরুন্দি থানা।

চট্টগ্রাম:

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১, চট্টগ্রাম: আনোয়ারা, বাঁশখালি, বোয়ালখালি ও চন্দনাইশ থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২, চট্টগ্রাম: ফড়িকছড়ি, পাহাড়তলী, হাটহাজারী, লোহাগড়া ও মীরসরাই থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩, চট্টগ্রাম: পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও সন্দ্বীপ থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪, চট্টগ্রাম: সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড, আকবরশাহ ও বাইজিদ বোস্তামী থানা।

  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫, চট্টগ্রাম: বাকুলিয়া, বন্দর, চাঁন্দগাও ও চকবাজার থানা।


আমাদের শেষকথা:

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২৫ দ্রুত বিচার ও ভুক্তভোগী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তবে বিচার ব্যবস্থায় অতিরিক্ত বাধা না সৃষ্টি করা, ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার সরে না যায় তা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রশিক্ষণ, সচেতনতা ও অভিযোজনমূলক আইনি কর্মসূচি গুরুত্ব পাবে এই আইন বাস্তবায়নে।

Next Post
No Comment
Add Comment
comment url