Abdul Mannan Khan vs. Government of Bangladesh Case Study – Martial Law Regulation এর বৈধতা নিয়ে ঐতিহাসিক রায়


আসসালামু আলাইকুম,
Law Ministry BD ওয়েবসাইট এর পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই সু-স্বাগতম । আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় Abdul Mannan Khan vs. Government of Bangladesh Case Study – Martial Law Regulation এর বৈধতা নিয়ে ঐতিহাসিক রায় সম্পর্কে।

 বাংলাদেশের সংবিধান গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার এবং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে একাধিক সময়ে সামরিক শাসন, মার্শাল ল’ এবং অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দেশে চালু হয়। এসব সময়ে জারি করা হয় Martial Law Regulation (MLR), যা মূলত সংবিধান ও মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক।

Abdul Mannan Khan vs. Government of Bangladesh মামলা সেই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়, যেখানে আদালত প্রশ্ন তোলে – “সামরিক আইন বা মার্শাল ল’ রেগুলেশন কি বৈধ হতে পারে?”

এই কেসটি শুধু একটি ব্যক্তিগত মামলা নয়, বরং বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে গণতন্ত্র বনাম সামরিক শাসন এর সংঘাতের প্রতিফলন।


Abdul Mannan Khan vs. Government of Bangladesh Case Study – Martial Law Regulation মামলার পটভূমি

স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে চলতে শুরু করলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কয়েকবার সামরিক শাসন জারি হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর সেনাবাহিনী দেশের ক্ষমতা দখল করে। এর পর বিভিন্ন সামরিক শাসকরা Martial Law Proclamation এবং Martial Law Regulation জারি করেন।

এইসব বিধানের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা সীমিত করা হয়, মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয় এবং অসংখ্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়।

মামলার উদ্ভব

অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, একজন নাগরিক ও আইনজীবী, মার্শাল ল’ রেগুলেশন এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি যুক্তি দেন যে—

  • সংবিধান অনুযায়ী জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা সংসদে ন্যস্ত।

  • কোনো সামরিক শাসক বা অগণতান্ত্রিক শক্তি সংসদের ক্ষমতা খর্ব করতে পারে না।

  • Martial Law Regulation সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ এবং ২৬-৪৪ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

এর ফলে বিষয়টি আদালতে যায় এবং High Court Division মামলাটি শুনানি করে।


মামলার প্রধান আইনগত প্রশ্ন

১. Martial Law Regulation কি বৈধ?
২. সামরিক শাসকের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন বা নতুন বিধি প্রণয়ন কি সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত?
৩. সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার নীতি লঙ্ঘন হয়েছে কি না?
৪. মৌলিক অধিকার স্থগিতকরণ কি বৈধ হতে পারে?


পক্ষগুলোর যুক্তি

আবেদনকারীর (Abdul Mannan Khan) যুক্তি

  • জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদের হাতে ন্যস্ত। কোনো সেনাশাসক বা অগণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ সংবিধান পরিবর্তন বা বিধি প্রণয়ন করতে পারে না।

  • Martial Law Regulation দ্বারা মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে, যা সংবিধানের বিরুদ্ধে।

  • সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা কেবল জনগণের প্রতিনিধি সংসদের হাতে, কোনো সামরিক শাসকের হাতে নয়।

  • Martial Law Regulation গৃহীত হলে তা Rule of Law বা আইনের শাসনের ধারণার বিরুদ্ধে যায়।

সরকারের (Respondent) যুক্তি

  • রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে Martial Law জারি করা হয়েছিল।

  • “State necessity doctrine” (রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা তত্ত্ব) অনুযায়ী কিছু ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে সামরিক শাসনের অধীনে জারি করা বিধান বৈধ হতে পারে।

  • আদালতের এখতিয়ার সীমিত; আদালত রাজনৈতিক প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।


আদালতের রায়

হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত

হাইকোর্ট বিভাগ মামলাটি শুনে রায় দেয় যে—

  • Martial Law Regulation সংবিধান পরিপন্থী।

  • সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, এবং জনগণের পক্ষে কেবল সংবিধান প্রণীত কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।”

  • সামরিক শাসক বা মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয়, তাই তারা কোনোভাবেই আইন প্রণয়ন করতে পারে না।

  • মৌলিক অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতাও কেবল সংবিধান প্রদত্ত নিয়মে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত, সামরিক শাসকের হাতে নয়।

  • তাই আদালত ঘোষণা করে যে Martial Law Regulation অসাংবিধানিক, অবৈধ এবং বাতিল।

পরবর্তীতে আপিল বিভাগ

সরকার পক্ষ আপিল করলেও Supreme Court এর Appellate Division হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। এর ফলে স্পষ্ট হয়—
বাংলাদেশে Martial Law বা সামরিক শাসনের অধীনে জারি করা কোনো বিধান বৈধ নয়।


আইনি বিশ্লেষণ

১. সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ

এই মামলায় আদালত স্পষ্ট করে দেয় যে—

  • সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ।

  • জনগণের বাইরে কোনো কর্তৃপক্ষ সংবিধান পরিবর্তন বা আইন প্রণয়ন করতে পারে না।

২. Rule of Law এর নীতি

Martial Law Regulation “Rule of Law” বা আইনের শাসনের ধারণাকে ধ্বংস করে। আদালতের মতে, আইনের শাসন মানে সবাই আইনের অধীন, এমনকি সরকারও। সামরিক শাসন এই মূলনীতির বিরোধী।

৩. মৌলিক অধিকার

Martial Law Regulation দ্বারা মানুষের বাকস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, এমনকি বিচার পাওয়ার অধিকারও খর্ব করা হয়েছিল। আদালত ঘোষণা করে, এটি অগ্রহণযোগ্য

৪. রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা তত্ত্ব (Doctrine of State Necessity)

সরকার যুক্তি দিলেও আদালত স্পষ্ট জানায় যে—
“কোনো প্রয়োজন বা জরুরি পরিস্থিতি কখনো সংবিধানের উপরে হতে পারে না।”

৫. পূর্ববর্তী রায়ের সাথে সামঞ্জস্য

  • Anwar Hossain Chowdhury vs. Bangladesh (1989) – এখানে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না বলে রায় হয়।

  • Bangladesh Italian Marble Works Ltd. vs. Bangladesh (2005) – পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয় এবং সামরিক শাসনের বৈধতা প্রশ্নে রায় হয়।

  • Abdul Mannan Khan মামলা এই ধারাবাহিকতাকে আরও দৃঢ় করে।


মামলার গুরুত্ব

১. সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক অবস্থান
এই রায়ে স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশের সংবিধানের চোখে Martial Law সর্বাংশে অবৈধ

২. গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা
আদালত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার বিষয়টি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।

৩. আইনের শাসন দৃঢ়করণ
এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় Rule of Law বা আইনের শাসনের নীতি সুদৃঢ় করে।

৪. পূর্ববর্তী সামরিক শাসনকাল পর্যালোচনায় সহায়ক
এই রায় ভবিষ্যতে সামরিক শাসনের যেকোনো প্রয়াসকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করার জন্য আইনি দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করে।


সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

যদিও আদালতের রায় প্রশংসিত হয়েছে, তবে কিছু সমালোচনা রয়েছে—

  • আদালত অনেক দেরিতে এই ধরনের রায় দিয়েছে। যদি স্বাধীনতার পরপরই আদালত Martial Law কে অবৈধ ঘোষণা করত, তাহলে হয়তো বাংলাদেশে এতবার সামরিক শাসন আসত না।

  • রায় কার্যকর হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক দিন অব্যাহত ছিল।

  • তবুও এটি গণতন্ত্রের প্রতি আদালতের দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রমাণ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।


উপসংহার

Abdul Mannan Khan vs. Government of Bangladesh মামলা বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এই রায়ের মাধ্যমে আদালত ঘোষণা করে—

  • Martial Law Regulation অসাংবিধানিক এবং অবৈধ।

  • জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কখনো সামরিক শাসকের হাতে যেতে পারে না।

  • Rule of Law, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে কোনো সমঝোতা হতে পারে না।

এই রায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করার একটি শক্তিশালী আইনি অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url