বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ – ধারা ১ ও ২ (সংজ্ঞাসমূহ) সহজ ব্যাখ্যা


বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ মূলত শ্রমিকদের অধিকার, মজুরি, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা, ক্ষতিপূরণ, ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি নিয়ে। তবে সরকারি অফিস, মুনাফাবিহীন প্রতিষ্ঠান, ছোট কৃষিখামার, গৃহপরিচারক, পরিবার-নির্ভর ব্যবসা ইত্যাদিতে এই আইন প্রযোজ্য নয়।

ধারা ১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম, প্রবর্তন এবং প্রয়োগ

(১) এই আইনের নাম হবে – বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬

(২) এই আইন সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে।

(৩) সাধারণভাবে, এই আইন সারা বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে।

(৪) তবে নিচে যেসব প্রতিষ্ঠান বা শ্রমিকের নাম দেওয়া হলো, তাদের উপর এই আইন প্রযোজ্য হবে না –

(ক) সরকার বা সরকারের অধীনে কোনো অফিসে কর্মরত শ্রমিক।

(খ) সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস।

(গ) অস্ত্র ও গোলাবারুদের কারখানা।

(ঘ) এমন কোনো প্রতিষ্ঠান যেটি মুনাফার জন্য নয়, বরং অসুস্থ, অক্ষম, বৃদ্ধ, গরিব, প্রতিবন্ধী, এতিম, পরিত্যক্ত নারী-শিশু বা বিধবাদের চিকিৎসা, যত্ন বা সেবার জন্য চালানো হয়।

(ঙ) মেলা বা প্রদর্শনীতে খোলা দোকান/স্টল – যেটিতে শুধু খুচরা বিক্রি হয়।

(চ) ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে মেলায়/বাজারে খোলা দোকান বা স্টল।

(ছ) মুনাফার জন্য নয় – এমন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

(জ) ছাত্রাবাস, মেস, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

(ঝ) দ্বিতীয় অধ্যায়ের ক্ষেত্রে – সরকারের মালিকানাধীন ও সরাসরি সরকারের দ্বারা পরিচালিত দোকান, শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান – যেখানে শ্রমিকদের জন্য সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ম-কানুন প্রযোজ্য।

(ঞ) যেসব শ্রমিকের চাকরির শর্তাবলী সংবিধানের ধারা ৬২, ৭৯, ১১৩ বা ১৩৩ অনুযায়ী করা আইন/বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
তবে কিছু ক্ষেত্রে এই ছাড় থাকবে না, যেমন –
১) রেল বিভাগ
২) ডাক, তার ও টেলিফোন বিভাগ
৩) সড়ক ও জনপথ বিভাগ
৪) গণপূর্ত বিভাগ
৫) জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ
৬) সরকারি মুদ্রণালয়

(ট) উপরের খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ ধারায় যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া অন্য কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কিছু অধ্যায় (১২, ১৩, ১৪) প্রযোজ্য হবে।

(ঠ) নাবিকদের ক্ষেত্রে – ১২, ১৩ ও ১৪ অধ্যায় ছাড়া বাকি ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।

(ড)  বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৫৮ নং আইন) এর ২ ধারাবলে বিলুপ্ত।

(ঢ) এমন কৃষি খামার যেখানে সাধারণত পাঁচজনের কম শ্রমিক কাজ করেন।

(ণ) গৃহপরিচারক।

(ত) যেসব প্রতিষ্ঠান মালিক নিজ পরিবার-সদস্যদের সহযোগিতায় চালান, আর সেখানে বাইরে থেকে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করা হয় না।

ধারা ২–এর সম্পূর্ণ সংজ্ঞাসমূহ (Definitions)

  • অবসর (Retirement): নির্দিষ্ট বয়সে বা ২৫ বছর চাকরি পূর্ণ করে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়াকে বোঝায়।

  • আংশিক অক্ষমতা / সম্পূর্ণ অক্ষমতা: কাজের ক্ষমতা আংশিক বা পুরোপুরি হারানো।

  • উৎসব ভাতা (Festival Allowance): ধর্মীয় উৎসবের আগে মালিক কর্তৃক শ্রমিককে প্রদেয় ভাতা।

  • মজুরি (Wages): শ্রমিকের কাজের বিনিময়ে টাকায় প্রকাশযোগ্য সব ধরনের পারিশ্রমিক (কিন্তু বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা সুবিধা, ভ্রমণ ভাতা ইত্যাদি এর বাইরে)।

  • শ্রমিক (Worker): যিনি মজুরি বা বেতনের বিনিময়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বা শিল্পে কাজ করেন (দক্ষ, অদক্ষ, কারিগরি, অফিস সহায়ক), তবে শীর্ষ পর্যায়ের প্রশাসনিক/ব্যবস্থাপনাগত কর্মীরা এর বাইরে।

  • প্রতিষ্ঠান (Establishment): দোকান, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, পরিবহন, শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি যেখানে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়।

  • শিশু ও কিশোর (Child & Adolescent): ১৪ বছরের নিচে শিশু, ১৪–১৮ বছরের মধ্যে কিশোর, ১৮ বছরের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক।

  • ধর্মঘট (Strike) ও লক-আউট: শ্রমিকদের কর্মবিরতি বা মালিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা।

  • ট্রেড ইউনিয়ন ও CBA: শ্রমিকদের সংগঠন, যারা যৌথ দর-কষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

  • গ্রাচুইটি: চাকরি শেষে মালিক কর্তৃক শ্রমিককে প্রদেয় এককালীন অর্থ।

  • প্রসূতি কল্যাণ: মহিলা শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা।

  • শিল্প বিরোধ (Industrial Dispute): মালিক–শ্রমিক বা শ্রমিক–শ্রমিকের মধ্যে চাকরি/শর্তাবলী/কাজের পরিবেশ নিয়ে বিরোধ।

👉 সহজভাবে, এই সংজ্ঞাসমূহ ছাড়া আইন প্রয়োগ করা প্রায় অসম্ভব, কারণ প্রতিটি ধারা কার্যকর করার আগে আদালত বা ট্রাইব্যুনালকে দেখতে হয়—শ্রমিক বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে, মজুরি আসলে কী, ধর্মঘট বৈধ না অবৈধ ইত্যাদি।

এক নজরে ধারা ২ – সংজ্ঞাসমূহ (সম্পূর্ণ টেবিল আকারে)


শব্দ/টার্ম আইন অনুযায়ী সংজ্ঞা সহজ ব্যাখ্যা
(১) অবসর (Retirement) বয়স ৫৭ বছর পূর্ণ হলে বা ২৫ বছর চাকরি শেষে স্বেচ্ছায় অবসর। চাকরির শেষ ধাপ।
(২) আংশিক অক্ষমতা (Partial Disablement) দুর্ঘটনা/রোগে কিছু কাজের ক্ষমতা হারানো। শরীরের আংশিক ক্ষতি, পুরো কাজ না পারা।
(৩) সম্পূর্ণ অক্ষমতা (Total Disablement) স্থায়ীভাবে সব কাজের ক্ষমতা হারানো। একেবারে কাজের অযোগ্য।
(৪) উৎসব ভাতা (Festival Allowance) ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে শ্রমিককে প্রদত্ত ভাতা। ঈদ/পূজার আগে বোনাস।
(৫) গ্রাচুইটি (Gratuity) চাকরি শেষে এককালীন অর্থ। বিদায়ী সম্মানী।
(৬) ট্রেড ইউনিয়ন (Trade Union) শ্রমিক বা মালিকের সংগঠন যা আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত। শ্রমিকদের অধিকার সংগঠন।
(৭) CBA (Collective Bargaining Agent) নির্বাচিত ট্রেড ইউনিয়ন যা শ্রমিকদের হয়ে দর-কষাকষি করে। শ্রমিক প্রতিনিধি সংগঠন।
(৮) ধর্মঘট (Strike) শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে। দাবির জন্য কর্মবিরতি।
(৯) লক-আউট (Lock-out) মালিক ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে। শ্রমিকদের ঢুকতে না দেওয়া।
(১০) শিল্প বিরোধ (Industrial Dispute) শ্রমিক-মালিক/শ্রমিক-শ্রমিকের মধ্যে চাকরি, শর্ত, মজুরি নিয়ে বিরোধ। কাজের শর্ত নিয়ে ঝগড়া।
(১১) মজুরি (Wages) বেতন + ওভারটাইম + বোনাস ইত্যাদি (ভাড়া, চিকিৎসা, ভ্রমণ ভাতা বাদে)। শ্রমিকের আসল আয়।
(১২) শ্রমিক (Worker) যিনি বেতন/মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন (দক্ষ, অদক্ষ, কারিগরি, অফিস সহায়ক)। চাকরি করা ব্যক্তি।
(১৩) প্রতিষ্ঠান (Establishment) দোকান, ব্যবসা, কারখানা, পরিবহন ইত্যাদি। যেকোনো কর্মক্ষেত্র।
(১৪) শিল্প প্রতিষ্ঠান (Industrial Establishment) কারখানা, খনি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি। শিল্পকারখানা।
(১৫) দোকান (Shop) খুচরা বা পাইকারি ব্যবসার জায়গা। দোকানপাট।
(১৬) বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান (Commercial Establishment) ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। ব্যবসার জায়গা।
(১৭) শিশু (Child) ১৪ বছরের নিচে। অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক।
(১৮) কিশোর (Adolescent) ১৪–১৮ বছরের মধ্যে। অল্পবয়সী শ্রমিক।
(১৯) প্রাপ্তবয়স্ক (Adult) ১৮ বছরের বেশি। পূর্ণবয়স্ক শ্রমিক।
(২০) মহিলা (Woman) নারী শ্রমিক। মহিলা কর্মী।
(২১) প্রসূতি কল্যাণ (Maternity Benefit) মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা। গর্ভবতী মায়ের অধিকার।
(২২) নিয়োগপত্র (Appointment Letter) শ্রমিককে লিখিত নিয়োগ প্রমাণপত্র। চাকরির অফার লেটার।
(২৩) পরিচয়পত্র (Identity Card) প্রতিষ্ঠানের শ্রমিককে দেওয়া আইডি কার্ড। চাকরির প্রমাণপত্র।
(২৪) স্বাস্থ্য (Health) শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। সুস্বাস্থ্য।
(২৫) নিরাপত্তা (Safety) দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা। সেফটি ব্যবস্থা।
(২৬) কল্যাণ (Welfare) শ্রমিকদের উন্নতি ও সুবিধা। ভালো থাকা।
(২৭) কর্মঘন্টা (Working Hour) প্রতিদিন কাজের সময়। অফিস টাইম।
(২৮) অতিরিক্ত সময় (Overtime) নির্ধারিত সময়ের বাইরে কাজ। এক্সট্রা টাইম।
(২৯) সাপ্তাহিক ছুটি (Weekly Holiday) সপ্তাহে একদিন বাধ্যতামূলক ছুটি। রবিবার/শুক্রবার ইত্যাদি।
(৩০) ন্যূনতম মজুরি (Minimum Wage) সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন। সর্বনিম্ন বেতনের হার।
(৩১) ক্ষতিপূরণ (Compensation) কাজের সময় দুর্ঘটনায় শ্রমিক আহত হলে অর্থ প্রদানের নিয়ম। দুর্ঘটনা ক্ষতিপূরণ।
(৩২) শিক্ষানবিস (Apprentice) প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী শ্রমিক। ট্রেনি কর্মী।
(৩৩) নিয়োগকর্তা (Employer) মালিক বা যিনি শ্রমিক নিয়োগ দেন। বস/মালিক।
(৩৪) শ্রম পরিদর্শক (Inspector) সরকার কর্তৃক নিয়োজিত শ্রম আইন তদারকি কর্মকর্তা। শ্রম অফিসার।
(৩৫) শ্রম আদালত (Labour Court) শ্রম আইন সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির আদালত। শ্রমিক আদালত।
(৩৬) শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল (Labour Appellate Tribunal) শ্রম আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের জায়গা। আপিল আদালত।
(৩৭) গৃহপরিচারক (Domestic Worker) যিনি গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত। বাড়ির কাজের লোক।
(৩৮) দুর্ঘটনা (Accident) কর্মক্ষেত্রে হঠাৎ সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অঘটন।
(৩৯) বিপজ্জনক অপারেশন (Dangerous Operation) যেসব কাজে ঝুঁকি বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
(৪০) মালিক (Owner) যিনি প্রতিষ্ঠানের মালিক। কারখানা/দোকানের আসল মালিক।

📝 উপসংহার (Conclusion)

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬–এর ধারা ১ ও ২ পুরো আইনের মূল ভিত্তি। এখানে শ্রমিক, প্রতিষ্ঠান, মজুরি, ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়নসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি সংজ্ঞা স্পষ্টভাবে জানার ফলে শ্রমিক ও মালিক উভয়েই তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url