ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮: সহজ ভাষায় আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ধারণা
ফৌজদারি কার্যবিধি: (১৮৯৮ সালের ৫ নং আইন)
আইন! শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে আসে জটিল সব নিয়মকানুনের কথা। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে আইনগুলো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেগুলোকে যদি আমরা সহজভাবে বুঝতে পারি, তাহলে অনেক সুবিধা হয়। আজ আমরা কথা বলব ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি নিয়ে, যা আমাদের অপরাধ ও বিচার ব্যবস্থা বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফৌজদারি কার্যবিধি কী?
সহজ কথায়, ফৌজদারি কার্যবিধি হলো এমন একটি আইন যা আমাদের দেশের অপরাধমূলক কার্যকলাপের বিচার কীভাবে হবে, তার নিয়মকানুন বলে দেয়। যখন কোনো চুরি, ডাকাতি, মারামারি বা খুন হয়, তখন পুলিশ কীভাবে ব্যবস্থা নেবে, কীভাবে তদন্ত করবে, আদালতে কীভাবে বিচার হবে—এই সবকিছুই এই আইনে লেখা আছে। এটি মূলত একটি পদ্ধতির আইন, যা অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে সুশৃঙ্খল করে।
আইনের মূল বিষয়গুলো কী?
ধারা ১ । নাম ও কার্যকারিতা:
এই আইনটির পুরো নাম ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইন। এর মানে হলো, এটি ১৮৯৮ সালে তৈরি হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, এটি সেই বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয় এবং এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রযোজ্য।
ব্যাপ্তি: এই আইনটি বাংলাদেশের সব জায়গায় সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে, যদি কোনো বিশেষ আইন (যেমন: কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা পেশার জন্য তৈরি বিশেষ আইন) থাকে, তাহলে সেই আইন অনুযায়ী কাজ করা হয়। তবে সাধারণত, যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে এই আইনটিই মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
ধারা ২ । বাতিল
ধারা ৩ । (১) বাতিল
ধারা ৩ । (২) পুরোনো আইনের শব্দের পরিবর্তন:
আইনটি অনেক পুরোনো হলেও, সময়ের সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আগে ম্যাজিস্ট্রেটদের বিভিন্ন নাম ছিল, যেমন 'পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অফিসার' বা 'অধস্তন ম্যাজিস্ট্রেট'। এই আইন কার্যকর হওয়ার পর তাদের নতুন নাম দেওয়া হয়, যেমন:
'পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অফিসার' এখন '১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট'।
'অধস্তন ম্যাজিস্ট্রেট' এখন '২য় বা ৩য় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট'।
এই পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছিল যাতে আইনের ভাষা আরও স্পষ্ট হয় এবং বিচার প্রক্রিয়া সবার জন্য সহজবোধ্য হয়।
ধারা ৪ । কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা:
আইনের প্রতিটি ধারায় ব্যবহৃত শব্দের নিজস্ব অর্থ থাকে। যেমন:
(ক) "এডভোকেট": এর সহজ মানে হলো আইনজীবী। যিনি আদালতে আইনের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলেন, তিনিই এডভোকেট। এই আইনে এডভোকেট বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে যিনি আদালতে আইনি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য প্রচলিত আইন অনুযায়ী অনুমতিপ্রাপ্ত।
(কক) এ্যাটর্নি জেনারেল: তিনি হলেন সরকারের প্রধান আইনজীবী। এই পদের মধ্যে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এবং সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেলরাও অন্তর্ভুক্ত।
(খ) জামিনযোগ্য অপরাধ: এই ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ থানা থেকেই অথবা আদালত থেকে জামিন দিতে পারে। এর মানে হলো, অভিযুক্ত ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বা কিছু শর্ত মেনে সাময়িকভাবে মুক্তি পেতে পারেন। কোন অপরাধগুলো জামিনযোগ্য, তার একটি তালিকা ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিল-এ দেওয়া আছে। জামিনের অযোগ্য অপরাধ: এই অপরাধগুলো খুবই গুরুতর। এই ক্ষেত্রে সাধারণত পুলিশ জামিন দিতে পারে না, শুধু আদালতই বিবেচনা করে জামিন দিতে পারে। যেমন, হত্যা, ডাকাতি, গুরুতর আঘাত ইত্যাদি।
(গ) চার্জ মানে হলো অভিযোগনামা। যখন কোনো অপরাধের তদন্ত শেষে পুলিশের কাছে প্রমাণ থাকে যে একজন ব্যক্তি অপরাধ করেছেন, তখন তার বিরুদ্ধে আদালতে যে অভিযোগগুলো আনা হয়, সেগুলোকে চার্জ বা অভিযোগনামা বলা হয়। একটি মামলায় একাধিক চার্জ থাকতে পারে।
(ঘ) বাতিল।
(ঙ) "রাষ্ট্রীয় কেরাণি" হলো এই কোড দ্বারা রাষ্ট্রীয় কেরাণিকে প্রদত্ত কার্য সম্পাদনের জন্য প্রধান বিচারপতি দ্বারা বিশেষভাবে নিযুক্ত যে কোন অফিসার অন্তর্ভুক্ত হইবে।
(চ) "আমলযোগ্য অপরাধ" এটি এমন ধরনের গুরুতর অপরাধ, যেখানে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়াই সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারে বা অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারে। যেমন: চুরি, ডাকাতি, খুন ইত্যাদি।
(ছ) বাতিল।
(জ) ”নালিশ” মানে হলো অভিযোগ। যখন কোনো ব্যক্তি সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কোনো অপরাধের বিষয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন, তখন তাকে নালিশ বলা হয়। তবে, মনে রাখতে হবে, পুলিশের রিপোর্টকে নালিশ বলা হয় না।
(ঝ) বাতিল।
(ঞ) "হাইকোর্ট বিভাগ” বলতে ফৌজদারি আপিল কিংবা রিভিশনের জন্য হাইকোর্ট বিভাগ।
(ট) ইনকোয়ারী (জিজ্ঞাসাবাদ): এটি হলো বিচার শুরু হওয়ার আগে কোনো বিষয় বা অপরাধ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রক্রিয়া। এটি বিচার নয়, বরং বিচার শুরু হওয়ার আগের ধাপ।
(ঠ) তদন্ত (ইনভেস্টিগেশন): এটি হলো পুলিশ অফিসার বা অন্য কোনো ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি (ম্যাজিস্ট্রেট নন) দ্বারা পরিচালিত একটি প্রক্রিয়া। এর মূল উদ্দেশ্য হলো অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা, যাতে অপরাধীকে শনাক্ত করা যায় এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায়।
(ড) বিচারিক কার্যক্রম: বিচারিক কার্যক্রম হলো এমন প্রক্রিয়া, যেখানে আইন অনুসারে শপথ নিয়ে সাক্ষ্য (সাক্ষীর বক্তব্য) নেওয়া হয় বা নেওয়া যেতে পারে। সহজ কথায়, এটি হলো আদালতের এমন একটি কাজ যেখানে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয় এবং যা বিচার প্রক্রিয়ার অংশ।
(ঢ) আমল অযোগ্য অপরাধ: আমল অযোগ্য অপরাধ হলো সেই ধরনের অপরাধ, যার জন্য পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি বা পরোয়ানা (arrest warrant) ছাড়া গ্রেফতার করতে পারে না। সাধারণত, এগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর অপরাধ।
(ণ)
অপরাধ বলতে এমন কোনো কাজকে বোঝানো হয়েছে, যা করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র কাজ করা নয়, বরং কোনো কাজ না করা, যা করা উচিত ছিল (যেমন: দায়িত্ব অবহেলা), তাও অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ গবাদি পশুর বেআইনি প্রবেশ করায়, সেটাও এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।- (ত) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা: থানায় যিনি দায়িত্বে থাকেন, তিনিই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। যদি তিনি কোনো কারণে উপস্থিত না থাকেন (যেমন: অসুস্থতা বা অন্য কোনো কাজে বাইরে গেলে), তাহলে তার বদলে যে পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন, তাকেও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ধরা হবে। তিনি কনস্টেবল পদের উপরের কোনো কর্মকর্তা হবেন।
- (থ) স্থান: এই আইনে 'স্থান' বলতে শুধু কোনো খালি জায়গা বোঝানো হয় না। এর মধ্যে বাড়ি, দালান, তাঁবু এবং নৌযানও অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, এই জায়গাগুলোতে সংঘটিত অপরাধও আইনের আওতায় আসবে।
- (দ) বাতিল।
(ধ) থানা: এটি হলো সরকারের নির্ধারিত কোনো পুলিশ স্টেশন বা কেন্দ্র।
- (ন) পাবলিক প্রসিকিউটর: পাবলিক প্রসিকিউটর বা সরকারি কৌঁসুলি হলেন এমন একজন আইনজীবী, যাকে সরকার কোনো নির্দিষ্ট মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ করে। তিনি সাধারণত সরকারের পক্ষে আদালতে মামলা লড়েন। যদি তার নির্দেশে অন্য কোনো আইনজীবী কাজ করেন, তিনিও এর অন্তর্ভুক্ত হবেন।
- (প) উপজেলা: উপজেলা বলতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অনুযায়ী গঠিত উপজেলাকে বোঝানো হয়েছে, যা ১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত।
- (ফ) বাতিল।
- (ব) বাতিল।
(২) শব্দ দ্বারা কার্য করা: এখানে বলা হয়েছে যে, কোনো শব্দ দিয়ে যদি কোনো কাজকে বোঝানো হয়, তবে সেই কাজ না করা বা কাজটি থেকে বেআইনিভাবে বিরত থাকাও সেই শব্দের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন, যদি বলা হয় 'চুরি করা', তাহলে চুরি করতে গিয়েও যদি কেউ কিছু চুরি না করে ফিরে আসে, তবে সেই চেষ্টাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
ধারা-৪-ক। রেফারেন্স গঠন:
(১) এই আইনের অধীনে, যদি কোনো প্রসঙ্গে অন্য কিছু বোঝানো না হয়, তাহলে কাউকে উল্লেখ করার অর্থ হবে নিম্নরূপ:
(ক) "ম্যাজিস্ট্রেট" শব্দটি যদি সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয় (কোনো বিশেষ পদ ছাড়া), তাহলে তা দ্বারা একজন বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝানো হবে।
(খ) যদি "ম্যাজিস্ট্রেট" শব্দটি কোনো বিশেষ পদ সহ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু তা স্পষ্ট করে বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ করে না, তাহলে তা দ্বারা উপধারা (২)(খ)-তে উল্লেখিত ধরনের একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝানো হবে।
(গ) যদি "মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট" শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা দ্বারা:
(অ) একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝানো হবে, যদি তার দায়িত্ব উপধারা (২)(খ)-এর প্রকৃতির হয় (যেমন, প্রশাসনিক দায়িত্ব)।
(আ) একজন মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে অথবা, ক্ষেত্রবিশেষে, একজন মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝানো হবে, যদি তার দায়িত্ব উপধারা (২)(ক)-এর প্রকৃতির হয় (যেমন, বিচারিক দায়িত্ব)।
(ঘ) "সহকারী দায়রা জজ" বলতে যুগ্ম দায়রা জজকে বোঝানো হবে।
(ঙ) কোনো এলাকার প্রসঙ্গে যদি তা কোনো মহানগর এলাকার অন্তর্গত হয়, তাহলে তা দ্বারা সেই মহানগর এলাকাটিকেই বোঝানো হবে।
(চ) যদি কোনো মহানগর এলাকার মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলা হয়, তাহলে তা দ্বারা সেই এলাকার দায়িত্বে থাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝানো হবে।
(ছ) যদি কোনো মহানগর এলাকার বাইরে কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলা হয়, তাহলে তা দ্বারা সেই এলাকার দায়িত্বে থাকা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝানো হবে।
(২) যদি এই আইন ছাড়া অন্য কোনো আইনের অধীনে কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ এমন কোনো বিষয় সম্পর্কিত হয়:
(ক) যেখানে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাই করা হয় বা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তির শাস্তি বা জরিমানার সম্ভাবনা থাকে অথবা যার জন্য কোনো তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচার করা হয় এবং সে কারণে কাউকে হেফাজতে নেওয়া হয়।
(খ) যে কাজগুলো লাইসেন্স দেওয়া, কোনো লাইসেন্স স্থগিত করা বা বাতিল করা, কোনো ফৌজদারি মামলা চালানোর অনুমতি দেওয়া বা তা ফিরিয়ে নেওয়া—এই ধরনের প্রশাসনিক বা নির্বাহী ধরনের কাজের সাথে সম্পর্কিত, সেগুলোকে এই আইনের বিধান অনুযায়ী একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বের অধীনে আনা হবে।
ধারা-৫। দণ্ডবিধির অধীন অপরাধের বিচার:
(১) আমাদের দেশের প্রধান ফৌজদারি আইন দণ্ডবিধি-তে যেসব অপরাধের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ, বিচার এবং অন্যান্য ব্যবস্থা এই ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা নিয়ম অনুযায়ী করা হবে।
(২) অন্যান্য আইন অনুযায়ী অপরাধের বিচার: অন্যান্য যেসব আইনে অপরাধের কথা বলা আছে, সেগুলোর তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ, বিচার এবং অন্যান্য ব্যবস্থাও এই ফৌজদারি কার্যবিধির নিয়ম মেনেই করা হবে। তবে, যদি অন্য কোনো নির্দিষ্ট আইনে এসব অপরাধের তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ বা বিচার করার জন্য কোনো বিশেষ পদ্ধতি বা স্থান ঠিক করা থাকে, তাহলে সেই বিশেষ আইনটিই প্রযোজ্য হবে।
