বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ: প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক আদালত পর্যন্ত

 


বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ

(Historical Development of Courts in Bangladesh)

বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থা দীর্ঘ পাঁচ শতাধিক বছরের ইতিহাস বহন করে। এই বিকাশ প্রক্রিয়া মূলত পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত:
১. হিন্দু যুগ
২. মুসলিম যুগ
৩. বৃটিশ যুগ
৪. পাকিস্তান আমল
৫. বাংলাদেশ আমল


হিন্দু যুগ: প্রাচীন ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা

সময়কাল: খ্রিষ্ট জন্মের পূর্বে ও পরে প্রায় ১৫০০ বছর।

মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ন্যায়বিচারের প্রধান উৎস।

  • ন্যায়বিচার প্রদান রাজাধিরাজের পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হত।

  • রাজাকে সহায়তা করতেন প্রধান বিচারপতি, বিজ্ঞ ব্রাহ্মণ, মন্ত্রীবর্গ, প্রবীণগণ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা।

আদালতের গঠন কাঠামো

১. রাজ দরবার বা রাজ আদালত (The King’s Court):

  • সর্বোচ্চ আপীল আদালত।

  • গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো সরাসরি এখানেই বিচার হত।

  1. প্রধান বিচারপতির আদালত (Chief Justice’s Court):

    • রাজ আদালতের নিচে অবস্থান করত।

    • প্রধান বিচারপতি ও বোর্ডের অন্যান্য বিচারক (মূলত ব্রাহ্মণ) বিচার কার্য পরিচালনা করতেন।

  2. বিশেষ ট্রাইব্যুনাল (Special Tribunal):

    • কখনো কখনো প্রধান বিচারপতির অধীনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হত।

  3. শহর বা জেলা আদালত (Town/District Court):

    • সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হত।

    • স্থানীয় স্তরে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করত।

  4. গ্রাম পরিষদ (Village Council):

    • ৫ বা ততোধিক সদস্য মিলে গঠিত হত।

    • ক্ষুদ্র দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা বিচার করত।

আদালতের কার্যপদ্ধতি (Judicial Procedure in Hindu Period)

ক. মোকদ্দমার বিভিন্ন পর্যায় (Stages of a Suit)

একটি মোকদ্দমা চারটি ধাপে বিভক্ত ছিল:

  1. আরজি (Plaint)

  2. জবাব বা উত্তর (Reply/Answer)

  3. বিচার কার্য ও তদন্ত (Trial & Inquiry)

  4. আদালতের রায় বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত (Judgment/Decision)


খ. একাধিক বিচারক দ্বারা বেঞ্চ (Bench of More than One Judges)

  • ন্যায়বিচার একক বিচারক দ্বারা নিশ্চিত হয় না – এটাই ছিল মূলনীতি।

  • সাধারণত দুই বা ততোধিক বিচারক একত্রে বেঞ্চ গঠন করে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।

  • রাজা নিজেও পরিষদবর্গকে নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন।


গ. বিচারক নিয়োগ ও বিচারের মান (Appointment of Judge and Judicial Standard)

  • গোত্র/বর্ণভিত্তিক ছিল নিয়োগ ব্যবস্থা।

  • প্রধান বিচারপতি অবশ্যই ব্রাহ্মণ হতে হত।

  • শূদ্রদের বিচারক হওয়ার অধিকার ছিল না।

  • নারী বিচারক হওয়ার অধিকার পাননি।

  • বিচারককে নিরপেক্ষ থাকার শপথ নিতে হত।


ঘ. নজীরের মতবাদ (Doctrine of Precedent)

  • রাজ আদালতের সিদ্ধান্ত নিম্ন আদালতের উপর বাধ্যতামূলক ছিল।

  • উচ্চ আদালতের রায়কে গৃহীত আইনের মূলনীতি হিসেবে ধরা হত।


ঙ. সাক্ষ্য (Evidence)

  • তিন ধরনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হত:

    1. দালিলীক সাক্ষ্য (Documentary Evidence)

    2. মৌখিক সাক্ষ্য (Oral Evidence)

    3. দখল বা ভোগ (Possession as Evidence)

  • ফৌজদারী মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণও (Circumstantial Evidence) বিবেচিত হত।


চ. অর্ডিল বা চরিত্র পরীক্ষা (Trial by Ordeal)

যেখানে প্রমাণ পাওয়া যেত না, সেক্ষেত্রে অতিপ্রাকৃতিক/ধর্মীয় পরীক্ষার মাধ্যমে বিচার হতো। কিছু পদ্ধতি:

  1. অগ্নি পরীক্ষা (Ordeal by Fire) – আগুনের উপর হাঁটা বা লাল গরম লোহা হাতে ধরা।

  2. পানি পরীক্ষা (Ordeal by Water) – পানির নিচে থাকা বা প্রতিমা ধোয়া পানি পান।

  3. বিষ পরীক্ষা (Ordeal by Poison) – বিষ খাওয়া; বেঁচে থাকলে নির্দোষ গণ্য।

  4. ধান-শস্য পরীক্ষা (Ordeal by Rice-grains) – খোসাসহ ধান খেয়ে রক্ত পড়া না পড়া দেখা।

  5. লটারী পরীক্ষা (Ordeal by Lot) – ধর্ম ও অধর্মের প্রতীক থেকে টানা।


ছ. জুরীর মাধ্যমে বিচার (Trial by Jury)

  • বর্তমান অর্থে Jury ছিল না।

  • তবে সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিচারককে সহায়তা করতেন।

  • তারা সত্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতেন বিচারক।


জ. অপরাধ ও শাস্তি (Crime and Punishment)

  • মূল ধারণা: শাস্তি অপরাধীর পাপ মোচন করে সংশোধিত করে।

  • বিবেচ্য বিষয়: অপরাধের প্রকৃতি, সময়-স্থান, বয়স, আচরণ, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি।

  • শাস্তির ধরন:

    1. মৃদু তিরস্কার

    2. কঠোর ভর্ত্সনা

    3. জরিমানা

    4. দৈহিক শাস্তি (শাস্তির তীব্রতা বর্ণভেদে আলাদা ছিল)

  • কিছু কঠিন শাস্তি:

    • জীবন্ত দগ্ধ করা

    • পানিতে ডুবিয়ে মারা

    • হাতি দিয়ে পিষ্ট করা

    • শূলে চড়ানো

    • খন্ড খন্ড করে কেটে ফেলা


হিন্দু বিচার ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ (Defects of Hindu Judicial System)

  1. বিচারক নিয়োগে গোত্র/বর্ণ বিবেচনা – আধুনিক ধ্যানধারণা বিরোধী।

  2. নারীর অধিকার – সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত।

  3. বিচার পদ্ধতি ছিল খামখেয়ালী, ধর্মকেন্দ্রিক ও অমানবিক

  4. অর্ডিল/চরিত্র পরীক্ষার মতো প্রথা ছিল অন্যায্য ও ন্যায়নীতিবর্জিত

  5. বর্ণ বৈষম্য অপরাধ ও শাস্তির ক্ষেত্রে প্রকট ছিল।

মুসলিম যুগ: মধ্যযুগে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা

(Muslim Period: Judicial System in Medieval India)

সময়কাল

  • ১১০০ শতাব্দী থেকে মুসলিম যুগের সূচনা।

  • দুই ভাগে বিভক্ত:

    1. দিল্লীর সুলতানাত (1206 – 1526 খ্রি.)

    2. মুঘল সম্রাজ্য (1526 – 1857 খ্রি.)


সুলতানী আমলের আইন ব্যবস্থা (Legal System under the Sultanate)

কেন্দ্রীয় আদালতসমূহ (Courts at Centre)

  1. রাজ আদালত (King’s Court):

    • সভাপতিত্ব করতেন সুলতান নিজে।

    • আদি ও আপীল এখতিয়ার ভোগ করত।

    • সর্বোচ্চ আপীল আদালত।

    • দুইজন বিখ্যাত মুফতি সুলতানকে সহায়তা করতেন।

  2. দেওয়ান-ই-মাজালিম ও দেওয়ান-ই-রিসালাত:

    • যথাক্রমে সর্বোচ্চ ফৌজদারী ও দেওয়ানী আপীল আদালত।

    • সভাপতিত্ব করতেন প্রধান বিচারপতি (কাজী-উল-কুজ্জাত)।

  3. সদর জিহানের আদালত (1248 সালে প্রতিষ্ঠিত):

    • প্রধান বিচারপতির চেয়েও উচ্চ পদ।

    • দীর্ঘ সময় পৃথক ছিল, পরে একত্রিত হয়, আবার পৃথক করা হয়।

  4. দেওয়ান-ই-সিয়াসত:

    • মূলত ফৌজদারী আদালত।

    • রাষ্ট্রদ্রোহ ও সামরিক অপরাধ বিচার করত।


প্রধান কর্মকর্তারা (Key Officers)

  • মুফতি (Mufti): আইন বিশেষজ্ঞ, প্রধান বিচারপতির সহায়ক।

  • পণ্ডিত (Pandit): হিন্দু আইন বিশেষজ্ঞ, অমুসলিমদের দেওয়ানী বিরোধে সহায়তা করতেন।

  • মুহতাসিব (Mohtasib): বিধিবদ্ধ আইন ভঙ্গ সংক্রান্ত মামলার বিচার করতেন।

  • ডাডবাক (Dadbak): আদালতের রেজিস্ট্রার, সমন জারি, হাজিরা নিশ্চিতকরণ; ছোট দেওয়ানী মামলার বিচারও করতেন।


প্রাদেশিক আদালতসমূহ (Provincial Courts)

  1. নাজিম-ই-সুবাহ আদালত:

    • সভাপতিত্ব করতেন নাজিম।

    • আদি ও আপীল এখতিয়ার।

    • তাঁর রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লীর কেন্দ্রীয় আদালতে আপীল সম্ভব।

  2. কাজী-ই-সুবাহ আদালত:

    • প্রদেশের প্রধান কাজী সভাপতি।

    • দেওয়ানী ও ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচার।

    • জেলা কাজীর রায়ের বিরুদ্ধে আপীল এখতিয়ার।

  3. দেওয়ান-ই-সুবাহ:

    • রাজস্ব সংক্রান্ত মোকদ্দমার সর্বোচ্চ আদালত।

  4. সদর-ই-সুবাহ:

    • ধর্মীয়/যাজক সংক্রান্ত বিষয়, ভূমিদান, বৃত্তি প্রদান ইত্যাদি।


জেলা আদালতসমূহ (District Courts)

  1. জেলা কাজী আদালত:

    • দেওয়ানী ও ফৌজদারী মোকদ্দমা।

    • পরগনার আদালতের আপীল এখতিয়ার।

  2. ফৌজদারী আদালত (Faujder Court):

    • ক্ষুদ্র ফৌজদারী অপরাধের বিচার।

  3. মীর আদিলের আদালত:

    • ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়।

  4. কোতোয়াল আদালত:

    • পুলিশি ও পৌরসভা সংক্রান্ত মামলা।


পরগনা আদালত (Parganah’s Courts)

  • কাজী-ই-পরগনা আদালত: দেওয়ানী ও ফৌজদারী মোকদ্দমা (আপীল এখতিয়ার ছাড়া)।

  • কোতোয়াল আদালত: ক্ষুদ্র অপরাধ বিচার, প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করত।


গ্রামীণ আদালত (Village Courts)

  • গ্রাম পঞ্চায়েত: কয়েকটি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত।

  • স্থানীয় সব ধরনের দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার বিচার করত।

মুঘল যুগের আইন ব্যবস্থা (Legal System under the Mughal Administration)

১. ন্যায় বিচারের উৎস

  • সম্রাটকে ন্যায়বিচারের মূল উৎস ধরা হতো।

  • “মহকুমা-ই-আদালত” নামে একটি পৃথক বিভাগ ছিল আদালত নিয়ন্ত্রণের জন্য।


২. রাজধানীর আদালতসমূহ

  • রাজার আদালত (The Emperor’s Court): সম্রাট সভাপতিত্ব করতেন, সর্বোচ্চ আদালত, আদি ও আপীল এখতিয়ার।

  • প্রধান বিচারপতির আদালত (Court of Chief Justice): দেওয়ানী ও ফৌজদারী মোকদ্দমা এবং আপীল আদালত।

  • মুখ্য রাজস্ব আদালত (Chief Revenue Court): রাজস্ব সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আপীল আদালত।

  • বিশেষ আদালত:

    • কাজী-ই-আশকার → সামরিক অপরাধের বিচার।

    • দিল্লীর কাজী আদালত → স্থানীয় দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা।


৩. প্রাদেশিক আদালতসমূহ

  • গভর্নরের আদালত (Adalat-e-Nazim-e-Subah): গভর্নর সভাপতিত্ব করতেন, আদি ও আপীল এখতিয়ার।

  • কাজী-ই-সুবাহর আদালত: দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা + আপীল আদালত।

  • দেওয়ানের আদালত (Provincial Chief Revenue Court): রাজস্ব সংক্রান্ত আদি ও আপীল এখতিয়ার।


৪. জেলা আদালত

  • জেলা কাজীর আদালত: দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা।

  • ফৌজদার আদালত: দাঙ্গা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত মামলা।

  • কোতয়াল আদালত: ক্ষুদ্র ফৌজদারী মামলা।

  • আমলগুজারী কাছারী: রাজস্ব মামলা।


৫. পরগনার আদালত

  • কাজী-ই-পরগনাহ আদালত: দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা।

  • কোতয়াল আদালত: ক্ষুদ্র ফৌজদারী মামলা।

  • আমীন-ই-পরগনাহ: রাজস্ব মামলা।


৬. গ্রাম আদালত

  • গ্রাম পঞ্চায়েত: স্থানীয় দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা, আপীলের সুযোগ ছিল না।

  • জমিদার আদালত: ক্ষুদ্র দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা (শেষ পর্যায়ে ক্ষমতা দেওয়া হয়)।


৭. অপরাধ ও শাস্তি ব্যবস্থা

  • আইন নির্ভর ছিল ফিকহ-ই-ফিরোজশাহী এবং ফতোয়া-ই-আলমগীরী-এর উপর।

  • সাক্ষ্য ৩ ভাগে বিভক্ত ছিল → দৃঢ় সমর্থন, একক সত্যতা, স্বীকারোক্তি।

  • অপরাধ শ্রেণী:

    1. সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ

    2. রাজার বিরুদ্ধে অপরাধ

    3. ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ

শাস্তির ধরন:

  1. হাদ্দ (Hadd): স্থির শাস্তি → হাত কাটা, পাথর নিক্ষেপ ইত্যাদি।

  2. তাজির (Tazir): বিবেচনামূলক শাস্তি → জিহ্বা কাটা, শূলে চড়ানো ইত্যাদি।

  3. কিসাস ও দিয়াত (Qisas & Diya): প্রতিশোধনমূলক শাস্তি বা রক্তমূল্য।


৮. বিচার ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ

  • নির্বাহী ও বিচার বিভাগ পৃথক ছিল না।

  • আইন অনেক সময় পরস্পরবিরোধী।

  • অপরাধকে সামাজিক ক্ষতি হিসেবে না দেখে ব্যক্তিগত ক্ষতি হিসেবে গণ্য করা হতো।

  • দিয়াত বা রক্তমূল্য গ্রহণ প্রথা অপব্যবহার হতো।

  • সাক্ষ্য আইন ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক।

  • শাস্তি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর (পাথর নিক্ষেপ, অঙ্গচ্ছেদ ইত্যাদি)।


👉 মুঘল আমলে বিচারব্যবস্থা ছিল মূলত শরীয়াভিত্তিক। আদালতের শ্রেণী বিভাজন ও প্রশাসনিক কাঠামো সুসংগঠিত হলেও শাস্তি ব্যবস্থা ছিল অমানবিক ও ত্রুটিপূর্ণ। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইনব্যবস্থা সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তনের প্রভাবে বিকাশ লাভ করেছে।

বৃটিশ যুগে ভারতীয় আইনের আধুনিকায়ন

(British Period: Modernisation of Ancient Indian Law)

ভারতীয় আইন ও বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়নের কৃতিত্ব মূলত বৃটিশদের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়।

বৃটিশ আমলের বিচারব্যবস্থা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়ঃ


প্রথম পর্যায়: ১৭২৬ সালের চার্টারের পূর্ব পর্যন্ত প্রারম্ভিক ব্যবস্থা

(First Period: Early Administration of Justice until the Charter of 1726)

১. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমিকা

  • রয়েল চার্টারের মাধ্যমে ভারতে আসে।

  • প্রথমে কেবল বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছিল উদ্দেশ্য, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা প্রশাসন ও বিচারকাজে হস্তক্ষেপ শুরু করে।

২. ফ্যাক্টরি থেকে প্রেসিডেন্সী শহরে উত্তরণ

  • মাদ্রাজ, বোম্বে ও কলকাতায় কোম্পানি ফ্যাক্টরি স্থাপন করে।

  • এগুলো পরে প্রেসিডেন্সী টাউন নামে পরিচিত হয়।

  • আশেপাশের অঞ্চলকে বলা হতো মফস্বল

৩. প্রেসিডেন্সী শহরের বিচারব্যবস্থা

  • ১৭২৬ সালের পূর্বে তিন প্রেসিডেন্সী শহরের বিচারব্যবস্থা ছিল অসংগঠিত ও বিশৃঙ্খল

  • কোম্পানি ও স্থানীয় মুঘল প্রশাসন একসঙ্গে বিচার পরিচালনা করত।

৪. প্রথম মেয়র আদালত

  • ১৬৮৭ সালের চার্টার অনুযায়ী মাদ্রাজে প্রথমবারের মতো Mayor’s Court গঠিত হয়।

  • এটি ছিল কোম্পানির আদালত, ক্রাউন আদালতের বিপরীতে

  • কিন্তু এ আদালতের জন্য কোম্পানি কোনো পূর্ণাঙ্গ আইন বা প্রক্রিয়া তৈরি করেনি।

৫. মফস্বলে বিচার ব্যবস্থা

  • কোম্পানি প্রথমবারের মতো ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেয়।

  • যদিও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির হাতে চলে আসে, তবুও ১৭৭২ সাল পর্যন্ত দেওয়ানি ও ফৌজদারী বিচার পুরনো পদ্ধতিতেই স্থানীয়রা চালাত।

  • তাই এই সময়ে মফস্বলের বিচারব্যবস্থাকে আলাদা ধাপে (পরে) আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ মেয়র আদালতের সময়কাল

(Second Period: The Era of the Mayor’s Court, 1726–1773)

বিভাজন

  • ১৭২৬ সালের চার্টার → ১৭৫৩ সালের চার্টার পর্যন্ত

  • ১৭৫৩ সালের চার্টার → ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট পর্যন্ত


১. ১৭২৬ সালের চার্টারের অধীনে বিচার ব্যবস্থা

দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থা (Civil Judiciary)

  • প্রতিটি প্রেসিডেন্সী শহরে (কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ) Mayor’s Court গঠিত হয়।

  • গঠন: ১ জন মেয়র + ৯ জন অলডারম্যান।

  • আদালত ছিল কোর্ট অব রেকর্ড → আদালত অবমাননায় শাস্তি দিতে পারত।

  • মেয়র আদালত ছিল সরাসরি রয়্যাল কোর্ট (রাজা থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত), কোম্পানি থেকে নয়।

  • এখতিয়ার: প্রেসিডেন্সী শহর ও ফ্যাক্টরীগুলোর সব দেওয়ানী মামলা।

  • আপীলের ধাপ:

    1. মেয়র আদালত → গভর্নর-ইন-কাউন্সিল

    2. গভর্নর-ইন-কাউন্সিল → ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিল (যদি মামলার মূল্য ≥ 1000 Pagoda)

  • প্রথমবার ভারতীয় মামলার জন্য প্রিভি কাউন্সিলে আপীলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।


ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা (Criminal Judiciary)

  • Justices of the Peace:

    • গভর্নর + কোম্পানির কাউন্সিলের ৫ জন সিনিয়র সদস্য।

    • অপরাধীদের গ্রেফতার, লঘু অপরাধে শাস্তি, গুরুতর অপরাধ কোয়ার্টার সেশনে প্রেরণ।

  • Court of Quarter Sessions:

    • ৩ জন জাস্টিস অব পীস বসতেন।

    • বছরে ৪ বার বৈঠক।

    • হত্যাকাণ্ড ব্যতীত প্রায় সব অপরাধ বিচার।

    • গ্রান্ড জুরিক্ষুদ্র জুরি ব্যবহৃত হতো।

  • Governor-in-Council:

    • গুরুতর দেশদ্রোহিতা ও জঘন্য অপরাধে এখতিয়ার রাখত।

    • মূল ও আপীল উভয় ক্ষমতা ছিল।


১৭২৬ সালের চার্টারের অধীনে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি

  1. ফৌজদারী বিচার পুরোপুরি নির্বাহী নিয়ন্ত্রণে (Governor-in-Council)।

  2. মেয়র আদালতও নির্বাহী প্রভাবমুক্ত ছিল না।

  3. অলডারম্যানরা ছিলেন ব্যবসায়ী/কোম্পানি কর্মচারী → অপেশাদার বিচারক।

  4. বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সম্পর্ক অস্পষ্ট → সংঘাত (যেমন Shrimp’s Case, Arab Merchant Case, Pagoda Oath Case)।

  5. মেয়র আদালতের এখতিয়ার অনির্দিষ্ট → ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি।


২. ১৭৫৩ সালের চার্টারের অধীনে বিচার ব্যবস্থা

মূল সংস্কার

  • স্থানীয় অধিবাসীদের মামলায় মেয়র আদালতের এখতিয়ার সীমিত করা হয় (যদি না উভয়পক্ষ রাজি থাকে)।

  • মেয়র ও অলডারম্যান নিয়োগ → কোম্পানির সরকারের অধীনে।

  • Court of Requests প্রতিষ্ঠা করা হয় (প্রতিটি প্রেসিডেন্সীতে)।

    • ৫ Pagoda পর্যন্ত ক্ষুদ্র দেওয়ানী মামলা দ্রুত ও সংক্ষিপ্তভাবে বিচার।

    • উদ্দেশ্য → দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের সাহায্য করা।


আপীল কাঠামো (Appeal Structure)

  • প্রিভি কাউন্সিল: একমাত্র সর্বোচ্চ আপীল আদালত।

  • Governor-in-Council:

    • দেওয়ানী → কেবল আপীল এখতিয়ার।

    • ফৌজদারী → মূল ও আপীল উভয় এখতিয়ার।

  • Mayor’s Court: ৫ Pagoda-এর বেশি মূল্যের দেওয়ানী মামলা।

  • Court of Requests: ৫ Pagoda পর্যন্ত মামলা।


১৭৫৩ সালের চার্টারের অধীনে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি

  1. বিচার বিভাগ কোম্পানির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে।

  2. বিচারকরা কোম্পানির কর্মচারী → আইনে অজ্ঞ।

  3. গভর্নর-ইন-কাউন্সিল → ইংলিশ আইন সম্পর্কে অজ্ঞ হয়েও বিচার করত।

  4. প্রিভি কাউন্সিলে আপীল → জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ।

  5. ভারতীয়দের বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

  6. ফৌজদারী বিচার প্রশাসন রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত।


👉  ১৭২৬–১৭৭৩ সাল পর্যন্ত “মেয়র আদালতের যুগে” বৃটিশ শাসকরা ভারতীয় আইনব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এ সময়ের আদালতগুলো ছিল অপেশাদার, নির্বাহী নিয়ন্ত্রিত এবং ভারতীয়দের জন্য বৈষম্যমূলক।

তৃতীয় পর্যায়ঃ সুপ্রীম কোর্টের সময়কাল

(১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট থেকে ১৮৬১ সালের একীভবন পর্যন্ত)


পটভূমি

  • মেয়র আদালতের ত্রুটি দূর করতে হলেও (১৭৫৩ সালের চার্টারেও) ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি।

  • ১৭৭২ সালে হাউজ অব কমন্স কোম্পানির কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য Secret Committee গঠন করে।

  • কমিটি রিপোর্ট দেয় → মেয়র আদালত ন্যায়বিচারের বদলে অত্যাচারের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

  • এর ভিত্তিতে ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস হয় → রাজাকে কলকাতায় সুপ্রীম কোর্ট স্থাপনের ক্ষমতা প্রদান।

  • ১৭৭৪ সালে কলকাতায় সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়

  • পরবর্তীতে →

    • ১৮০১ সালে মাদ্রাজে,

    • ১৮২৪ সালে বোম্বেতে → মেয়র আদালতের স্থলে সুপ্রীম কোর্ট প্রতিস্থাপিত হয়।


সুপ্রীম কোর্টের গঠন ও এখতিয়ার

গঠন

  • ১ জন প্রধান বিচারপতি + ৩ জন সহকারী বিচারপতি।

  • সবাইকে পেশাদার ব্যারিস্টার হতে হতো এবং ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো হতো।

  • রাজার ইচ্ছামতো তাদের চাকরি বহাল থাকত।

এখতিয়ার ও ক্ষমতা

i) তিন প্রেসিডেন্সী শহরে মেয়র আদালতের স্থলে সুপ্রীম কোর্ট প্রতিস্থাপিত হয়।
ii) Court of Requests বহাল থাকলেও ১৮৫০ সালে বিলুপ্ত → তার স্থলে Small Causes Court গঠিত হয়।
iii) তত্ত্বাবধানমূলক এখতিয়ার → Collector, Quarter Session, Justices of Peace, Court of Requests প্রভৃতির উপর।

  • Writ jurisdiction (রীট জারি করার ক্ষমতা) প্রবর্তিত হয়।
    iv) সাধারণ এখতিয়ার → প্রেসিডেন্সী শহরের মধ্যে সীমিত।

  • তবে তিন শ্রেণির উপর বাইরেও এখতিয়ার প্রয়োগ করত:

    1. বৃটিশ নাগরিক

    2. কোম্পানির প্রত্যক্ষ কর্মচারী

    3. কোম্পানির পরোক্ষ কর্মচারী
      v) মূল, আপীল, দেওয়ানী, ফৌজদারী, যাজকীয় ও নৌবাহিনী সংক্রান্ত এখতিয়ার ছিল।
      vi) মফস্বল আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল শুনত।
      vii) আপীল ব্যবস্থা:

  • 1000 Pagoda-এর বেশি মূল্যমান হলে প্রিভি কাউন্সিলে আপীল করা যেত।

  • ফৌজদারী মামলায় দ্বিতীয় আপীলের অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল সম্পূর্ণ সুপ্রীম কোর্টের হাতে।


আপীল কাঠামো (Hierarchy of Appeals)

  1. Privy Council (সর্বোচ্চ)

  2. Supreme Court

  3. Governor-in-Council

  4. Court of Requests (১৮৫০ পর্যন্ত)

  5. Court of Quarter Sessions

  6. Justices of Peace


সুপ্রীম কোর্টের কার্যক্রমের ত্রুটি

(Defects in Working of the Supreme Court)

i) এখতিয়ার সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব → বিশেষত Patna CaseCossijurah Case
ii) রেগুলেটিং অ্যাক্ট বা ১৭৭৪ সালের চার্টারে সুপ্রীম কোর্ট ও কোম্পানির কোর্টের সম্পর্ক নির্দিষ্ট না থাকায় দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
iii) কাউন্সিল বনাম সুপ্রীম কোর্ট → শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্ব।
iv) দ্বৈত বিচারব্যবস্থা →

  • প্রেসিডেন্সীতে সুপ্রীম কোর্ট,

  • মফস্বলে কোম্পানির আদালত।
    → এখতিয়ার নিয়ে ক্রমাগত সংঘাত।
    v) বিখ্যাত মামলা:

  • রাজা নন্দকুমার কেস

  • রাধাচরণ, কামালুদ্দিন, স্বরূপচাঁদ

  • Patna Case, Cossijurah Case
    → এগুলো রেগুলেটিং অ্যাক্ট ও ১৭৭৪ চার্টারের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে।


১৭৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রীম কোর্ট ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় সূচনা করে।

তবে এটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয় দুটি কারণে:

  1. রেগুলেটিং অ্যাক্ট ও ১৭৭৪ সালের চার্টারের সীমাবদ্ধতা,

  2. কোম্পানি প্রশাসনের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ

ফলস্বরূপ, দ্বৈত বিচারব্যবস্থা, এখতিয়ারসংক্রান্ত সংঘাত এবং নির্বাহী–বিচার বিভাগের দ্বন্দ্ব এই সময়কালের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।

চতুর্থ পর্যায় — একীভূতকরণের সময়কাল (১৮৬১–১৯৪৭)

(Era of Unification — Judicial Reform under Direct British Rule)

১. প্রারম্ভিক প্রেক্ষাপট — কেন একীভূরণ দরকার পড়ল?

  1. সুপ্রীম কোর্ট বনাম নির্বাহী (Company/Council) দ্বন্দ্ব — সুপ্রীম কোর্ট এবং কোম্পানীর/কাউন্সিলের মধ্যে ব্যাপক সংঘাত ও এখতিয়ারের দ্বন্দ্ব, বিভাগের সীমা অনির্দিষ্ট থাকায় আদালত-নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকারিতায় সমস্যা হচ্ছিল।

  2. ডিক্রি কার্যকর না হওয়া — প্রেসিডেন্সী এবং মফস্বল দু’পাশেই ডিক্রি জারি ও কার্যকর করতে সমস্যা। ফলে বিচারিক আদেশ বাস্তবায়নে বাধা পড়ছিল।

  3. দুই সমান্তরাল ব্যবস্থা (Presidency Crown courts ও Mufassil Company courts) — একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ডিক্রি ও বিরোধিতার জন্ম হোত; সমন্বয়ের প্রয়োজন বোধ হলো।

  4. জনসাধারণ ও প্রশাসনিক অভিযোগ — বাধ্যতামূলক সংস্কারের দাবী উচ্চ করেই উঠল (কমিটি, পিটিশন ইত্যাদি) — তাই সংহত ব্যবস্থা জরুরি হয়ে গেল।


২. একীভূতকরণে ধাপে-ধাপে প্রধান পদক্ষেপসমূহ

ধাপ ১ — আইনকমিশি ও পরামর্শ (প্রথম উদ্যোগ):

  • ১৮৫৩ সালে প্রথম ল’-কমিশন গঠিত হয়; সর্বভারতীয় আইনসভা প্রতিষ্ঠার মত প্রস্তাব ইত্যাদি।

  • পরবর্তীতে দ্বিতীয় আইন কমিশন ছিল বদল আনার প্রস্তুতির দায়িত্বে — সুপ্রীম কোর্ট ও সদর (sadar) আদালত মিলানোর পদ্ধতি প্রণয়ন ইত্যাদি।

ধাপ ২ — কোম্পানী থেকে রাজ্যগত শাসনে পরিবর্তন (1858):

  • ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন বিলুপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় শাসন গ্রহণ করে — এটি একীভূতকরণ ত্বরান্বিত করে।

ধাপ ৩ — বিধিবদ্ধকরণ (কোডিকিকেশন):

  • দেওয়ানী কার্যবিধি, ফৌজদারী কার্যবিধি ও দণ্ডবিধি (একক সংহিতা) — সাধারণ আইন কাঠামো একত্রিত করে। (এই কোডিকিকেশনের ফলে বিচার প্রক্রিয়া সারাবিশ্বে একরকমে অভিন্নীকরণের পথ সুগম হলো)।

ধাপ ৪ — Indian High Courts Act, 1861 → হাইকোর্টের প্রতিষ্ঠা:

  • ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮৬১ সালে Indian High Courts Act পাস করে।

  • এর মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্ট ও সদর আদালতগুলোকে যুক্ত করে তিনটি হাইকোর্ট (কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ) স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। (কলকাতায় সনদে ১৮৬২ — ২ জুলাই থেকে কার্যকর)।


৩. একীভূতকরণের পর — নতুন (উপস্থিত) বিচারব্যবস্থা: মূল পরিবর্তন ও বিধান

  1. দুই সমান্তরাল ব্যবস্থার অবসান — সভাপতিত্বমূলক সুপ্রীম কোর্ট ও মফস্বল কোম্পানী আদালতগুলোকে মিলিয়ে High Court of Judicature প্রতিষ্ঠিত হলো।

  2. অধিষ্ঠান ও বিলুপ্তি — সুপ্রীম কোর্ট, সদর দেওয়ানী আদালত ও সদর নিজামত আদালত বিলুপ্ত/অবক্ষেপিত হল।

  3. হাইকোর্টের এখতিয়ার ও সীমা:

    • হাইকোর্টের স্থানীয় (local) মূল ও সাধারণ এখতিয়ার ছিল প্রেসিডেন্সী শহরের মধ্যে।

    • এক্ষেত্রে পূর্বসূরী সুপ্রীম কোর্ট যে অতিরিক্ত (extra-territorial) কিছু ক্ষমতা ভোগ করত, সেগুলো কিছু ক্ষেত্রে হাইকোর্টও অনুশীলন করতে পেরেছে (কিন্তু সীমাবদ্ধ)।

    • হাইকোর্টের আওতায় ছিল দেওয়ানী ও ফৌজদারী (Small Causes ব্যতীত) অধিকাংশ মামলা।

  4. আপীল ব্যবস্থা:

    • হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রিভি কাউন্সিলে (Privy Council) আপীলের সুযোগ রয়ে গেল; সাধারণত ১০,০০০ রুপির বেশি মূল্যের মামলায় দ্বিতীয় আপীল ছিল প্রিভি কাউন্সিলে।

    • হাইকোর্ট নিজেই প্রিভি কাউন্সিলে আপীলযোগ্যতা সম্পর্কে মতামত দেওয়ার ক্ষমতা পায়।

  5. সকল অধস্তন আদালতসমূহের তত্ত্বাবধান — হাইকোর্ট সকল নিম্ন আদালতের (দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় ক্ষেত্রে) উপর তত্ত্বাবধানমূলক কর্তৃত্ব রাখে।


৪. একীভূতকরণের পর — নিয়মিত স্তরবিন্যাস (কানুনানুসারে)

দেওয়ানী (নাগরিক) আদালত — (Civil Courts) — (Civil Courts Act, 1887 অনুসারে)
১. District Judge (জেলা জজ)
২. Additional District Judge (অতিরিক্ত জেলা জজ)
৩. Subordinate Judge / Sub-Judge (অধস্তন বিচারক)
৪. Munsif (মুন্সেফ / স্থানীয় সিভিল ম্যাজিষ্ট্রেট)

  • পাশাপাশি Small Causes Court — ছোট দেওয়ানী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য (Small Causes Act, 1887)।

ফৌজদারী (ক্রিমিনাল) আদালত — (Criminal Procedure বিধি — 1898)
১. Court of Sessions (Sessions Judge / জেলা দায়রা আদালত)
২. Presidency Magistrates (প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট)
৩. First Class Magistrates (প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট)
৪. Second Class Magistrates (দ্বিতীয় শ্রেণীর)
৫. Third Class Magistrates (তৃতীয় শ্রেণীর)

  • (প্রাথমিক তদন্ত, চার্জশিট, ট্রায়াল, দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা ইত্যাদি অনুযায়ী শ্রেণীভিত্তিক ক্ষমতা নির্ধারিত)।

সংস্থানগত বিন্যাস (সারমর্মে):
Privy Council (শীর্ষ) ↑ High Court ↑ District Judge (Sessions Judge / Civil Judge (Senior)) ↑ Subordinate / Munsif ↑ Magistrates (various classes)


৫. মফস্বল অঞ্চলের (Mufassil) বিচারব্যবস্থার বিবর্তন — সংক্ষিপ্ত পটভূমি (কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ)

(এই অংশটি বোঝা জরুরি কারণ ১৭৭২–১৮৬১ অবধি মফস্বল বিচারব্যবস্থা ধাপে ধাপে বড় ফর্মে বদল হয়েছিল এবং পরে একীকরণের মূল ভিত্তি গড়ে তোলে)

  1. ওয়ারেন হেস্টিংসের পরিকল্পনা (1772) — বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার জন্য প্রথম কৌশল: সদর দেওয়ানী ও মফস্বিল দেওয়ানী (জেলা পর্যায়ে) এবং সদর নেজামত ও মফস্বিল ফৌজদারী আদালত; কালেক্টর/অফিসারদের বিচার বিভাগীয় ভূমিকা।

  2. ১৭৭৪, ১৭৮০ পরিকল্পনা — প্রাদেশিক আদালত, বিভাগীয় আপীল ব্যবস্থা, বিচারকে রাজস্ব থেকে পৃথক করার প্রচেষ্টা।

  3. করনওয়ালিস-হেস্টিংস-বেন্টিঙ্ক-হেস্টিংস ইত্যাদি সংস্কার (১৭৮৭–১৮১৪ … ১৮২৮–১৮৩৫) — জেলা ও সার্কিট, রেজিস্ট্রার কোর্ট, মুন্সেফ, সদর আমীন ইত্যাদি আদালত কাঠামো; কমিশনার ও কালেক্টরের ম্যাজিস্ট্রেটিক ক্ষমতার পরিমার্জন।

  4. ফলাফল: মফস্বিল অঞ্চলে জেলা-স্তরের বিচার ব্যবস্থা (district & sessions) গঠিত হলো—এটাই পরে হাইকোর্ট-এর অধীনে একীভূত হল।


৬. ফেডারেল কোর্ট ও হাইকোর্টের যুগ (১৯৩৫–১৯৪৭) — সংক্ষেপে

  1. Government of India Act, 1935 — কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি ও এক ধরনের ফেডারেল গঠনের বিধান; একইসাথে Federal Court স্থাপনের বিধান।

  2. Federal Court বাস্তবায়ন: ১ অক্টোবর ১৯৩৭-এ Federal Court কার্যকর হয়।

    • গঠন: প্রধান বিচারপতি + ২ জন বিচারক।

    • যোগ্যতা: (i) হাইকোর্ট বিচারপতি হিসেবে ৫ বছর; বা (ii) ব্যারিস্টার ১০ বছর; বা (iii) হাইকোর্টেপ্লিডার ১০ বছর ইত্যাদি।

  3. ফেডারেল কোর্টের এখতিয়ার: কেন্দ্র ও প্রদেশের মামলায় বিশেষ ক্ষমতা; গভর্নর জেনারেল বা গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্নে উপদেশমূলক এখতিয়ার; সীমিত আপীল ক্ষমতা।

  4. আপীল লাইন: হাইকোর্ট → (শর্তসাপেক্ষ) Federal Court → Privy Council (আদেশ থাকলে) — স্বাধীনতার আগে এই ব্যবস্থা ছিল।


৭. স্বাধীনতা (১৯৪৭) ও পরবর্তী অবস্থা (সংক্ষেপে — India & Pakistan)

  1. ১৫ আগস্ট ১৯৪৭: ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন। Government of India Act, 1935 সাময়িকভাবে কার্যকর রইল যতক্ষণ না নতুন সংবিধান গৃহীত হয়।

  2. প্রিভি কাউন্সিলের এখতিয়ার: পরে একে একে বাতিল করা হয় — ভারতের জন্য ১৯৪৯ সালের আইন (Privy Council Appeals abolition) এবং ১৯৫০-এ ভারতের সংবিধান ও সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রিভি কাউন্সিলে আপীল প্রথা বন্ধ।

  3. পাকিস্তান/পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশের পূর্বাগ্র): ১৯৪৭-এর পর করাচীতে/ঢাকায় প্রয়োজনমত ফেডারেল কোর্ট/হাইকোর্ট স্থাপিত হয়; পরে ১৯৫০–১৯৫৬/৬২ পর্যন্ত পাকিস্তানে বিভিন্ন আইনগত বদল ঘটল (Privy Council প্রত্যাহার, Federal Court → Supreme Court ইত্যাদি)।


৮. ইতিহাসের উপসংহার — চূড়ান্ত শিক্ষা ও বাংলাদেশে ঐতিহ্য

  1. একীভূতকরণ-ফল: ১৮৬১–১৯৪৭ সময়ে ব্রিটিশরা পেশাদার, স্তরভিত্তিক ও একীকৃত আদালত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে — যা বর্তমান বাংলাদেশের নিশ্চিত মূল কাঠামোর মূল উৎস।

  2. আইনি কোড-উত্তরাধিকার: IPC / CrPC / Evidence / Civil Procedure-ধাঁচ (বড় অংশে) ব্রিটিশ যুগ থেকেই এসেছে—তারপর স্থানীয়ভাবে সংশোধন ও অভিযোজন ঘটেছে।

  3. বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব: সুপ্রীম কোর্ট বনাম নির্বাহী দ্বন্দ্ব, প্রিভি কাউন্সিল-আপীল প্রথা, হাইকোর্টের ক্ষমতা — সবই বিচারিক স্বাধীনতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ধাপ।

  4. মফস্বিল-প্রশাসনিক প্রভাব: জেলা-স্থানীয় আদালত (District & Sessions; Munsif ইত্যাদি)-এর উত্পত্তি ও পরির্বতন (Warren Hastings → Bentick → Hastings → Bentick reforms) হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত ছিল।


সংক্ষিপ্ত টাইমলাইন (মুখ্য মাইলস্টোন)

  • ১৭৭২-১৭৮০: Warren Hastings পরিকল্পনা (মফস্বিল বিচার কাঠামো)

  • ১৭৭৩: Regulating Act → সুপ্রীম কোর্ট (কলকাতা) প্রতিষ্ঠার পথ খুললো

  • ১৮৫3–৫৮: আইন কমিশন ও Crown takeover (১৮৫৮) — একীভূতকরণ ত্বরান্বিত

  • ১৮৬১: Indian High Courts Act → ১৮৬২-এ হাইকোর্ট কার্যকর (কলকাতা)

  • ১৮৮৭: Civil Courts Act (নাগরিক আদালত কাঠামো)

  • ১৮৯৮: Criminal Procedure Code (ফৌজদারী আদালত কাঠামো)

  • ১৯৩5: Government of India Act → Federal Court বিধান; ১৯৩৭-এ Federal Court কার্যকর

  • ১৯৪৭: স্বাধীনতা (India & Pakistan), পরে প্রিভি কাউন্সিলের স্থানোপন এবং সুপ্রীম কোর্ট-এর প্রতিষ্ঠা (প্রতিটি দেশেই সময়ভিত্তিক)


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url