৮ম সংশোধনী মামলা (Anwar Hossain Chowdhury vs. Bangladesh, 1989): মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক রায়

 


আসসালামু আলাইকুম, Law Ministry BD ওয়েবসাইট এর পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই সু-স্বাগতম । আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ৮ম সংশোধনী মামলা (Anwar Hossain Chowdhury vs. Bangladesh, 1989): মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক রায় সম্পর্কে।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত মামলাগুলোর একটি হলো Anwar Hossain Chowdhury vs. Bangladesh (1989)। এই মামলার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সংবিধানে Basic Structure Doctrine বা মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয়, এ মামলার রায় আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার “রক্ষাকবচ” তৈরি করেছে।


মামলার পটভূমি

১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ছিল একটি একক রাষ্ট্রব্যবস্থা (Unitary System) সম্বলিত প্রজাতন্ত্র, যেখানে সংসদীয় গণতন্ত্রবিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল মূল বৈশিষ্ট্য।

কিন্তু ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময় সংবিধানের ৮ম সংশোধনী আনা হয়।

৮ম সংশোধনীর মূল বিষয়:

  1. High Court Division কে বিভক্ত করা হয়—

    • একাংশ থাকে ঢাকায়,

    • আরেকটি নতুন শাখা গড়ে তোলা হয় চট্টগ্রামে

  2. সরকারের যুক্তি ছিল— দেশের বিচারপ্রার্থী জনগণের সুবিধার্থে আঞ্চলিক হাইকোর্ট প্রয়োজন।

  3. কিন্তু সমালোচকরা বলেছিলেন— এটি সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খণ্ডিত করার একটি রাজনৈতিক প্রচেষ্টা।

এই সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন Anwar Hossain Chowdhury এবং আরও কয়েকজন।


মামলার মূল প্রশ্ন

আদালতে প্রধান প্রশ্ন দাঁড়ায়—

  1. জাতীয় সংসদের সংশোধনী ক্ষমতা সীমাহীন নাকি সীমিত?

  2. সংসদ কি চাইলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করতে পারবে?

  3. ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভক্তি কি সংবিধানের এককতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক?


আদালতের রায়

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের Appellate Division ১৯৮৯ সালে রায় প্রদান করে।

রায়ের মূল বক্তব্য:

  1. সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে পারবে, তবে সেটা সীমাহীন নয়।

  2. সংবিধানের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো কোনো সংসদ পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারবে না।

  3. ৮ম সংশোধনী আদালতের এককতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মৌলিক কাঠামো নষ্ট করেছে।

  4. তাই ৮ম সংশোধনী অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।


মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব (Basic Structure Doctrine)

এই মামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো Basic Structure Doctrine প্রতিষ্ঠিত হয়।

কোন কোন বিষয়কে “মৌলিক কাঠামো” বলা হয়?

  1. গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র

  2. জনগণের সার্বভৌমত্ব

  3. একক রাষ্ট্রব্যবস্থা

  4. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

  5. মৌলিক অধিকার

  6. আইনের শাসন (Rule of Law)

  7. সংবিধানের সর্বোচ্চতা

➡ এগুলো সংবিধানের অপরিবর্তনীয় ভিত্তি। সংসদ এগুলো সংশোধন করতে পারবে না, কেবল সংবিধানের সাধারণ ধারাগুলো সংশোধন করা সম্ভব।


রায়ের তাৎপর্য

এই রায় বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক মাইলফলক

  1. সংসদের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

  2. সংবিধানকে রাজনৈতিক দল বা সামরিক শাসকের হাতে খেলার বস্তু হতে বাধা দেয়।

  3. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধানের সর্বোচ্চতা রক্ষা হয়।

  4. পরবর্তীতে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত অনেক মামলায় এই রায় প্রধান নজির (landmark precedent) হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।


সমালোচনা

তবে এই রায়ের কিছু সমালোচনাও আছে—

  • কেউ কেউ বলেন, “মৌলিক কাঠামো” শব্দটি সংবিধানে নেই, এটি আদালতের তৈরি একটি তত্ত্ব।

  • ফলে আদালত সংসদের ওপর অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে।

তবুও, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন— বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় এই রায় ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।


উপসংহার

Anwar Hossain Chowdhury vs. Bangladesh (1989) বা ৮ম সংশোধনী মামলা শুধু একটি রায় নয়, বরং বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়—
👉 সংবিধান কেবল ক্ষমতাসীনদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী পরিবর্তনযোগ্য নয়, বরং এর কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়।


✍️ সহজভাবে মনে রাখো:
➡ ৮ম সংশোধনী = হাইকোর্ট বিভক্তি → আদালত বাতিল করে → মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url